মহালয়ার ভোর বীরেন ভদ্রের, জায়গা পাননি উত্তম কুমারও
কলকাতা:
রুপালি পর্দায় মহানায়ক দশকের পর দশক ধরে
দর্শকদের মনোরঞ্জনে সক্ষম হলেও মহালয়ার একটি
দিন বীরেন্দ্রকৃষ্ণের জায়গায় তাঁকে মেনে নেননি আমজনতা।
পঙ্কজকুমার মল্লিকের সুর, বাণী কুমারের
সৃষ্টি এবং সর্বোপরি বীরেন
ভদ্রের কণ্ঠের প্রতিলিপি হয় না, এ
কথা বারবার বুঝিয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। আকাশবানীর
সমস্ত অনুষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান এই মহিষাসুরমর্দিনী। বাঙালির
দুর্গাপুজো শুরুই হয় না, আশ্বিনের
শারদ প্রাতে..... না শুনলে।
প্রতিবছর ভোর ৪টের সময়
রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্রপাঠ এবং কালজয়ী সমস্ত
গান জানান দেয় উমা আসছে।
১৯৩২-এর দুর্গা ষষ্ঠীর
দিন ভোরবেলা প্রথম বার প্রচারিত হয়
কালজয়ী অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী। পরের বছর ১৯৩৩
সালে সম্প্রচারিত হয় প্রভাতী অনুষ্ঠান
নামে। ১৯৩৬ সালে
এই অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়
'মহিষাসুর বধ' এবং ১৯৩৭
সালে এই অনুষ্ঠানের প্রথম
নামকরণ হয় 'মহিষাসুরমর্দিনী', যা আজও
রয়ে গিয়েছে। প্রথম দু’বছর অর্থাৎ ১৯৩২
ও ৩৩ সালে অনুষ্ঠানটি
ষষ্ঠীর ভোরে সম্প্রচারিত হয়।
১৯৩৪ সালের ৮ অক্টোবর প্রথমবার
‘মহালয়া’-র সকালেই গীতিআলেখ্য অনুষ্ঠানটির সম্প্রচার হয়েছিল। বলাবাহুল্য, বীরেন ভদ্রর সেই গম্ভীর কণ্ঠে
চণ্ডীপাঠ শুধু মহালয়া নয়
গোটা পুজোর প্রাণ ভোমরা, এ বিষয়ে মহানায়ক
উত্তম কুমারকেও হার মানতে হয়েছিল।
প্রসঙ্গত আকাশবাণীর 'মহিষাসুরমর্দিনী’, কেবলমাত্র একটি রেডিও অনুষ্ঠান
নয় আর, বরং বাঙালির
জীবনের সঙ্গে তা আজ ওতপ্রোতভাবে
জড়িত। একটি অনুষ্ঠান কোন
উচ্চতায় পৌঁছলে, সামগ্রিকভাবে একটি জাতির পুজো
পার্বণের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে যায়। আকাশবাণীর
প্রযোজনায় এই অনুষ্ঠান বহু
রদবদলের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। বর্তমানে
আমরা যে রেকর্ডিংটি শুনতে
পাই, সেটির রূপদান করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র,
পঙ্কজকুমার মল্লিক ও বাণী কুমার।
দীর্ঘ সময় ধরে মহিষাসুরমর্দিনী
সম্প্রচারের পর হঠাৎ ১৯৭৬
সালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পরিবর্তে মহালয়ার অনুষ্ঠান করেন উত্তমকুমার। সমগ্র
বাঙালি সে বছর তীব্র
প্রতিবাদ জানায়। ফলে পরের বছর
থেকেই আবার স্বমহিমায় আকাশবাণীর
অনুষ্ঠানে ফিরে আসেন বীরেন
ভদ্র। তাই তাঁর কণ্ঠ
কতটা আবেগের যে বাঙালি তাদের
মহানায়ককেও নাকচ করতে পারে,
তা অবশ্যই ভেবে দেখার বিষয়।
চিরাচরিত কণ্ঠকে বাদ দিয়ে মহালয়ার
ভোরে উত্তম কুমার-এর গলায় চণ্ডীপাঠ
শুনে রেগে আগুন হয়
আপামর বাঙালি। সম্প্রচারের পর থেকেই শুরু
হয় বিক্ষোভ। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র বদলে সেইবার সম্প্রচারিত
হয়েছিল ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম’। মহানায়কের গলায় শোনার পরই
ফোনের পর ফোন আসতে
শুরু করে। বহু অভিযোগ
জমা হতে থাকে আকাশবাণীর
অফিসে। অনেকেই অফিসের সামনে জড়ো হয়েছিলেন। কাতারে
কাতারে বিক্ষুব্ধ মানুষ দাবি তোলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ
ভদ্রকে ফিরিয়ে আনার। বাঙালির আবেগকে সেদিন অস্বীকার
করতে পারেনি আকাশবাণী। রীতিমত বাধ্য হয়েই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের
অনুষ্ঠান পুনরায় সম্প্রচার করা হয়। ষষ্ঠীর
দিন সকালেই আকাশবাণী তা সম্প্রচার করে।
উল্লেখ্য, স্কটিশচার্চ কলেজের প্রাক্তন ছাত্র বীরেন ভদ্র আকাশবাণীর প্রধান
ছিলেন। তাঁকে বাদ
দিয়ে আকাশবাণী আজও কিছুই ভাবতে
পারে না। বহু নাটকের
প্রোডাকশন ছিল তাঁর, যাতে গলা দিতেন
ছবি বিশ্বাস, অহীন্দ্র চৌধুরী সহ দিকপালরা। এছাড়া,
বিকাশ রায়ের প্রতিভা বীরেন্দ্রকৃষ্ণই প্রথম আবিস্কার করে বলেন "বিকাশ
সিনেমায় চেষ্টা করো, তোমার হবে।"
এছাড়া, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে উত্তম কুমার, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিধানচন্দ্র রায় প্রমুখের অন্তিমযাত্রার বিবরণও দিয়েছিলেন স্বয়ং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ।
Article by: শুভদীপ রায় চৌধুরী