লাল ও বেলগোলাপের মোমের মালা দিয়ে সাজানো হয় শান্তিপুরের চাঁদুনী মাকে

1

লাল বেলগোলাপের মোমের মালা দিয়ে সাজানো হয় শান্তিপুরের চাঁদুনী মাকে

শান্তিপুর: আর কয়েকদিন বাদেই দীপাবলি, আলোর উৎসবে মাতবে আট থেকে আশি সকলেই। কলকাতার পাশাপাশি নদিয়ার শান্তিপুরে জাঁকজমক ভাবে কালীর আরাধনা হয়। প্রাচীন আগমেশ্বরীর পাশাপাশি একাধিক সুপ্রাচীন কালীপুজো দেখতে ভিড় করেন সকলে। শান্তিপুরের চাঁদুনী বাড়ির কালীপুজো বহুদিনের। আগমেশ্বরীর নয়নভোলানো রূপের পাশাপাশি চাঁদুনী মায়ের দিব্যজ্যোতির সাক্ষি থাকতে শান্তিপুরে ছুটে আসেন ভক্তরা। তবে এই মুখোপাধ্যায় পরিবারে দুর্গাপুজোর চলও বহুদিনের।

   প্রসঙ্গত, এই পরিবারের পূর্বপুরুষ কাশীনাথ মুখোপাধ্যায় (সার্বভৌমের) ভাই গোপীনাথ মুখোপাধ্যায় (সার্বভৌম) দীর্ঘদিন তন্ত্রসাধনা করতেন। বলাবাহুল্য, কাশীনাথ মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর ভাই গোপীনাথ পণ্ডিত ছিলেন এবংসার্বভৌমউপাধি পান। এই মুখোপাধ্যায় পরিবারের প্রতিষ্ঠিত রঘুনাথ রয়েছেন, সেই রঘুনাথ জীউকে সেবা দেওয়ার জন্য একদিন গোপীনাথ বাগানে ফুল তোলার সময় এক বালিকা তাঁর কাছে প্রসাদ চাইলে তিনি বলেন পূজার পর প্রসাদ দেবেন। আর পুজোর শেষে প্রসাদ দিতে এলেই আর বালিকাকে খুঁজে পাননি। তারপর এক রাতে তিনি মায়ের আদেশ পান যে,  “তোর বাড়ির অদূরেই এক কূর্মপীঠ আছে, সেখানে পঞ্চমূণ্ডির আসনে আমাকে  পূজা কর। তুই যে মন্ত্রে আমাকে পূজা করবি, আমি তাতেই সন্তুষ্ট হবো।আর স্বপ্নাদেশ শেষ হলে গোপীনাথ সার্বভৌম সেই  কথা তাঁর মাকে জানান। সার্বভৌমের সেই  স্বপ্নাদেশ মতন মায়ের বিগ্রহ তৈরি হয়। 

   উল্লেখ্য, মুখোপাধ্যায় বাড়িতে কালীপুজোর আলাদা পুঁথি রয়েছে, যেই পুঁথি গোপীনাথ লিখেছিলেন। আজও সেই পুঁথি দেখেই মায়ের পুজো হয়। মুলত চাঁদুনীবাড়ির কালীপুজোয় দেবীঘট থাকলেও মূলপূজা যন্ত্রেই হয়। পুজোর দিন সকালে বাড়ির বউরা দেবীর ঘটে জল ভরতে যান।

    বলাবাহুল্য, এই বাড়িতে দুর্গাপুজোর দশমীর দিন ছেলেরা চাঁদুনী মায়ের কাঠামো দালানে নিয়ে আসেন মন্দির থেকে। সেই কাঠামোতে বাড়ির বয়ঃজ্যেষ্ঠা মাটির প্রলেপ দেন এবং তারপরই মূর্তি তৈরী শুরু হয়। কালী মন্দিরের সামনেই এক নহবতখানা তৈরী করা হয় যেখানে অমাবস্যার আগের একাদশীতিথি থেকে সানাই বসানো হয়, যারা ৮প্রহরে ৮বার বাজান। শান্তিপুরের চাঁদুনী মাকে সাবেকি ডাকের সাজ পরানো হয়। বিষয়ে কথা হল পরিবারের সদস্য সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি জানান, পুজোর আগের দিন চাঁদুনীমায়ের কেশসজ্জা বাড়ির ছেলেরাই করেন জবাকুসুমতেল দিয়ে। এর পাশাপাশি, চাঁদুনী মাকে মোমের দুটি মালা পড়ানো হয় একটি লাল এবং একটি বেলগোলাপের। চাঁদুনী মায়ের বিগ্রহ দুর্গাদালানেই তৈরী হয় এবং পুজোর দিন বাড়ির ছেলেদের কাঁধে করে তিনি নিজ মন্দিরে যান। পরিবারের প্রাচীন স্বর্ণালংকার এবং রৌপালংকার দিয়ে সাজানো হয় দেবীকে।

   এছাড়া, চাঁদুনী মাকে দুর্গাদালান থেকে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে খীরের মিষ্টি খাওয়ানো হয় এবং রূপোর ছাতা মাথায় নিয়ে তিনি মন্দিরে যান। পূজায় চণ্ডীপাঠ   খাঁড়াপূজাও হয়। মূলত, মায়ের পুজো  নিশিরাতে হয় এবং বাড়ির বয়ঃজ্যেষ্ঠ সদস্য  মায়ের পুজো করেন। পরিবারে এখনও  পাঁঠাবলি হয়। চাঁদুনীবাড়িতে কালী পুজোর সময় পাঁঠাবলির প্রথা বহু প্রাচীন। অনেক ভক্ত মায়ের কাছে মানত পূরণের জন্যও পাঁঠা প্রদান করেন। বাড়িতে নিরামিষ ভোগ প্রদান করা হয়। বিশেষ করে চাঁদুনী মায়ের জন্য বিশেষ সজ্জাও দেওয়া হয়। কালীপুজোর সময় বাড়ির গৃহদেবতারাও মন্দিরে উপস্থিত থাকেন। এদিনের ভোগে থাকে আট রকমের ভাজা, পোলাও,  সাদাভাত, খিঁচুড়ি, কলার বড়া, চালতার চাটনি, পায়েস, মিষ্টি ইত্যাদি। ভিয়েন বসিয়ে গজা, পকান্ন তৈরী করা হয় যা দূরদূরান্তে প্রসাদ হিসাবে যায়।  চাঁদুনী মায়ের গোটা ফলের নৈবেদ্য হয় এবং বারোমাসের যা ফল সমস্ত ফল এবং সবজী মাকে নিবেদন করা হয়। পরের দিন মায়ের কাঁধে করে বিসর্জন হয়। বাড়ির মেয়ে শ্বশুরের গৃহে ফিরে যাচ্ছেন বলে বিসর্জনের মাঝরাস্তায় বাজনা বন্ধ করে শোক পালন করা হয়।

Article by: শুভদীপ রায় চৌধুরী

Post a Comment

1Comments

  1. চন্দ্রাননী চন্দ্রশেখরী মা-র শুভ্র শোলার সাজ নয়নাভিরাম। একবার দর্শনেই সকল তমোবিকার নাশ হয়। উপর্যুপরি বিবিধ স্বর্ণালঙ্কারের সাজে মা যে সর্বার্থেই রাজরাজেশ্বরী তার প্রতীতি মনে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই উদিত হয়। ওঁ মা এর পূজার আয়োজনে ঐতিহ্য ও সুচারু শিল্পবোধ বাঙালির সুপ্রাচীন শাক্ত উপাসনার নান্দনিকতাকে প্রতিষ্ঠা করে। চাঁদুনি মা এর পূজার উপর একটি তথ্যচিত্র নির্মিত হোক, দূরদর্শন - কলকাতার কাছে এই আবেদন রাখি।

    ReplyDelete
Post a Comment