নবমীর দিন কুমারীপুজো হয় মশাটের চট্টোপাধ্যায় পরিবারে
কলকাতা:
পুজো আসতে বাকি আর
কয়েকটি দিন। এই মুহূর্তে
চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে মণ্ডপ থেকে
শুরু করে কুমোর পাড়ায়।
মহালয়ার ভোরে মহিষাসুরমর্দিনী দিয়েই
শুরু হবে বাঙালির শারদোৎসব।
বারোয়ারি মণ্ডপের পাশাপাশি বনেদি বাড়ির ঠাকুরদালানও সেজে উঠছে নিজস্ব
ছন্দে। ঝাড়বাতির আলো এবং একাচালির
দুর্গা প্রতিমা দেখতে বনেদি বাড়িতে হাজির হন দর্শনার্থীরা। হুগলির
মশাট অঞ্চলের চট্টোপাধ্যায় পরিবার, দশকের পর দশক ধরে
প্রাচীন রীতিনীতি মেনেই দুর্গাপুজো করে আসছন পরিবারের
বর্তমান প্রজন্মের সদস্যরা।
প্রসঙ্গত, তিনশো বছরের প্রাচীন এই দুর্গাপুজো আজও
অনুষ্ঠিত হয় হুগলির মশাটে। মূলত
চট্টোপাধ্যায় পরিবার যেখানে বসবাস করেন, সেকালে সরস্বতী নদীর এক শাখানদী
কৌশিকী নদী বইতো। পরিবারের
আদিপুরুষ পুরন্দর চট্টোপাধ্যায় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে এসে এই
নদীর তীরে স্থায়ী বসতি
নির্মান করেন।
সে সময়ে বর্ধমানের রাজা
চাঁদমাল বোরার অধীনে জনাইয়ের জমিদারির এই মশাট অঞ্চলের
খাজনা আদায়ের ভার ছিল এই
পরিবারের হাতে। ফলে জমিজমা কিংবা
আর্থিক অবস্থাও ভালোই ছিল। সেকালে চ্যাটার্জিদের
বাড়িটি “বাবুবাড়ি” নামে পরিচিত ছিল।
পুরন্দর চট্টোপাধ্যায় প্রথম দুর্গাপুজো শুরু করেন এ
বাড়িতে।
উল্লেখ্য, প্রায় ১১৬ বছর ধরে
এ বাড়ির দুর্গাপুজো কৌশিকী নদীর পাশেই মনসার
থানে অনুষ্ঠিত হত। তারপর গৌরমোহন
চট্টোপাধ্যায় পুজোকে স্থানান্তরিত করে নিজের বসতবাড়িতে
নিয়ে আসেন বাংলা ১১৬৯
সনে। গৌরমোহনের নয়
সন্তান পুজোর ভার পান। আজও
এই নয়টি বংশ মিলেই
পুজো করে আসছেন। এ
বিষয়ে কথা হল পরিবারের
সদস্য কেশব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
তিনি জানান, তাঁদের বসতবাড়ির মধ্যেই তিন থামের ঠাকুরদালানে
আজও দুর্গাপুজো হয়। দালানের সামনেই
রয়েছে নাটমন্দির। বাড়িটি কৌশিকী নদীর তীরে হলেও
বর্তমানে এই নদীর অস্তিত্ব
নেই বললেই হয়। সাবেকি একচালার
প্রতিমার তৈরি হয় এই
পরিবারে। কেশব বাবু এও
বলেন, নন্দোৎসবের
দিন কাঠামোপুজো হয় এবং তারপরই
ঠাকুরদালানেই তৈরি হয় প্রতিমা।
এ বাড়িতে দেবীর গায়ের রঙ শিউলি ফুলের
বোঁটার মতন। অতীতে, বংশপরম্পরায়
শিল্পীরা প্রতিমা তৈরি করতে আসলেও
বর্তমানে অন্য শিল্পীরা কাজ
করেন। বলাবাহুল্য, এ বাড়ির পুজো হয় বাড়ির
দীক্ষিত মহিলাদের নামেই। পুজো ষষ্ঠীর দিন
শুরু হলেও চণ্ডীপাঠ শুরু
হয় মহালয়ার পরের দিন থেকেই।
মায়ের বেদীর নীচে দেবীঘট প্রতিষ্ঠার
স্থানেই খোদাই করা রয়েছে তন্ত্রের
যন্ত্র। এছাড়া বংশের তিনটি শালগ্রাম শিলার সঙ্গে রয়েছেন বাণেশ্বর শিব, গণেশ ও
কালী। সম্পূর্ণ বৈষ্ণবমতে পুজো হয় বলে
কোন আমিষভোগ হয়
না। এই কারণে পরিবারে
এবং সমগ্র গ্রামে মহালয়া থেকে দশমী পর্যন্ত
নিরামিষ খাওয়া হয়। মায়ের ভোগে
মোচা ও থোর দেওয়ার
চল রয়েছে। দশমীর দিন দেবীকে নিবেদন
করা হয় পান্তাভোগ।
উল্লেখ্য, একবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বসতবাড়িটি পুড়ে যাওয়ায়, ওপর অভাব-অনটন শুরু হয়, সেইসময় থেকেই দেবীর আদেশে থোর ও মোচা নিবেদন করা হয়। প্রথমে তন্ত্রমতেই পুজো হত, হত ছাগবলিদান। তবে এখন বসতবাড়িটি স্থানান্তরিত হওয়ার পর একবার বলির সময় পাঁঠাটি হাড়িকাঠ থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেন গৌরমোহন চট্টোপাধ্যায়ের কাপড়ের আড়ালে। সেই বছর থেকে পশুবলি প্রথা উঠে যায় এ পরিবারে। পশুবলির পরিবর্তে মহানবমীর দিন বলি দেওয়া হয় পাঁচ রকমের ফল। সপ্তমীর দিন স্নানের ঘাটে নবপত্রিকার স্নান হয় এবং মহানবমীর দিন হয় কুমারীপুজো। দশমীর দিন ঘট বিসর্জনের পরই বেলায় দেবীকে নিয়ে যাওয়া হয় বিশ্বেশ্বরতলার দুধপুকুরের ধারে এবং সূর্য ডোবার আগেই বিসর্জন দিতে হয়। বিসর্জনের পর সকলে বাড়িতে এসে শান্তিজল নেন এবং শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমেই পুজোর সমাপ্তি হয়।
Article by: শুভদীপ রায় চৌধুরী