Monoholi Rajbari / Jamidarbari at Gangarampur, South Dinajpur District

Monoholi Rajbari / Jamidarbari at Gangarampur, South Dinajpur

ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে নিশুতি রাত গুমরে কাঁদে

এক পুরাতন রাজবাড়ীর গল্প

মুকুটটা তো পড়েই আছে রাজাই শুধু নেই

ছোটবেলা থেকেই আমরা বাঙ্গালী ছেলেমেয়েরা রূপকথার গল্প শুনতে খুব ভালোবাসি। রূপকথা মানেই একটা রাজবাড়ী থাকতে। থাকতে হবে চোখ ঝলমলে জৌলুশ। কিন্তু সেই ধরনের বাড়ি পশ্চিমবাংলায় গুটিকয় আছে। আর সেখানে থাকতে গেলে রীতিমতো মোটা অঙ্কের গ্যাঁটের কড়ি গুনতে হবে। যারা পারবেন তারা কড়ি গুনবেন। আর যারা পারবেন না তারা,


এক কালের চোখ ধাঁধানো প্রাসাদ যা আজ বয়সের ভারে জীর্ন, ক্ষয়িষ্ণু, প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। সেসব বাড়িতে গিয়ে কড়ি বরগা গুণতে পারেন। তারজন্য আলাদা করে কড়ি গুণতে হবে না। কিছু বাড়ির তো অস্তিত্বই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

চলুন, আজ আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো তেমনই একটা ক্ষয়িষ্ণু রাজবাড়ীর সাথে। মনোহালী রাজবাড়ী। দক্ষিন দিনাজপুরের তপন ব্লকের অন্তর্গত মনোহালী গ্রামে  বিশাল এলাকা নিয়ে দ্বিতল বিশিষ্ট এই রাজবাড়ী অবস্থিত। নামেই রাজবাড়ী। এখন আর রাজাও নেই, প্রজাও নেই।

এই মনোহালী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হলেন তারাচাঁদ বন্দ্যোপাধ্যায়। এনারা বর্ধমান মহারাজার রাজসভা আলোকিত করে রাখতেন নানা শাস্ত্রজ্ঞানের মাধ্যমে। এনাদের পদবী বন্দ্যোপাধ্যায় হলেও উপাধি ছিলো,  তর্করত্ন, তর্কবিশারদ, ন্যায়রত্ন, ন্যায়বাগীশ ইত্যাদি।



আজ থেকে দুশো বছরেরও আগে ১৮৩০ সালে দিনাজপুরের রাজা বন্ধুবর বর্ধমান মহারাজাকে অনুরোধ করেন এমন কাউকে তাঁর কাছে পাঠাতে, যিনি আজকের এই মনোহালী অঞ্চলে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, আরও মানুষের সাহায্যে এই অঞ্চলের উন্নতির জন্য কাজ করবেন।

কারণ তখন এই অঞ্চল ছিলো জঙ্গলাকীর্ণ, আর জলাভূমিময়। ছিলো ডাকাতদের আস্তানা। কে না জানে, জঙ্গল থাকলেই সেখানে হবে ডাকাতদের আস্তানা কিংবা তান্ত্রিকদের ডেরা।

তো, তারাচাঁদ বন্দ্যোপাধ্যায় শিক্ষিত মানুষ, শাস্ত্রজ্ঞানে পারদর্শী। এইসব বৈষয়িক ব্যাপার, প্রশাসনিক ব্যাপার তারপর ডাকাতদের সাথে মোকাবিলা করার মতো সাহস বা বুদ্ধি কোনোটাই ছিলো না। তবুও বর্ধমানের মহারাজার অনুরোধে এই চ্যালেঞ্জটা তিনি গ্রহণ করলেন। তিনি একদিন সপরিবারে এখানে এসে হোগলাপাতা দিয়ে ঘর তৈরি করে বসবাস শুরু করলেন। শাস্ত্রজ্ঞাণী মানুষ, ভালো ভালো কথায় ডাকাতদের মনেও আনলেন একটা পরিবর্তন। তারা বন জঙ্গল কেটে সাফ করে চাষবাসে মন দিলো। তাদের দৌলতে আরও কিছু লোক জুটে গেলো। শুরু হলো চাষবাস।



কিন্তু তারাচাঁদ বাবুর তাতে কোনো লাভ হলো না। খাজনা বাবদ প্রজাদের থেকে যে অর্থ অর্জন হয় তাতে তার সংসার চলে না।

তিনি গিয়ে দরবার করলেন দিনাজপুরের রাজার কাছে। রাজা সব শুনে তাঁকে কিছু অর্থ দিলেন। বললেন এই অর্থ প্রজাদের স্বল্প সুদে ঋণ দিতে। কোনোরকম অনৈতিক কাজ যেন না হয়। অনৈতিক কাজ যে হবে না তা দিনাজপুরের রাজা ভালো করেই জানতেন। শাস্ত্রজ্ঞ মানুষ কখনো লোক ঠকানোর কাজে নিজেকে নিয়োজিত করবে না। তখনকার দিনে এইসব  বিশ্বাসগুলো ছিলো।



যাইহোক, এই সুদের কারবারেই তারাচাঁদ বাবুর চরম আর্থিক উন্নতি হলো। তখন তিনি দুই সন্তানের পিতা। বড়ো ছেলে সুরেশ চন্দ্র, বড় তরফ, আর ছোট ছেলে যোগেশ্চন্দ্র, ছোট তরফ। কিছু সময় আগে পরে দুই ভাই দুই দিকে দ্বিতল প্রাসাদ নির্মান করলো। মাঝখানে দেউরি। ছোট তরফের দিকে তৈরি হলো সুদৃশ্য দুর্গামণ্ডপ। বাড়ি তৈরির নির্মান সামগ্রী যেমন লোহার কড়ি বরগা এসেছিলো ইংল্যান্ড থেকে নদীপথে। এখানে পুনর্ভবা নদীর ঘাটে সেই মাল নামানো হয়েছিলো। বাড়ির দেওয়ালে, থামের গায়, খিলানে অভিজ্ঞ মিস্ত্রি দ্বারা করা হয়েছিলো পঙ্খের কাজ। যার কিছু অবশিষ্টাংশ এখনো সেই উজ্জ্বল দিনগুলোর কথা বলে। বাড়িটির স্থাপত্যশৈলীও দেখবার মতন। তবে বড়ো তরফের বাড়ির দোতলায় ওঠার সিঁড়ি একেবারে ওপর থেকে ধ্বসে গেছে। যার ফলে সিঁড়ি দিয়ে আর দোতলায় ওঠা যায় না। ঘরগুলো কোনোক্রমে টিঁকে আছে। মই বা ওই জাতীয় সিঁড়ি ব্যবহার করে ওপরে ওঠা যায়। ছাদের বিমের জয়েন্টে মোটা মোটা শিলের ব্যবহার লক্ষ্যনীয়। যে শিলে আমরা মশলা বেটে থাকি সেরকম শিল।



ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন এই বাড়ির পঞ্চম জেনারেশন শ্রীমতি মায়া চক্রবর্তী। যাঁর বিয়ে হয়েছে কলকাতায়। এই সময় ফসল ওঠার সময়। তারই তদারকি করতে তিনি এখন কয়েকদিন এখানে আছেন।

বলছিলেন তাদের কুলদেবী মা ইচ্ছাময়ীর কথা। যে মূর্তিটি তৈরি করেছেন দাঁইহাটের নামী শিল্পী নবীন ভাস্কর। মূর্তিটি কষ্টিপাথরের তৈরি। এটি নবীন ভাস্করের চতুর্থ কালীমূর্তি।

এর আগে নবীন ভাস্কর তিনটি কালীমূর্তি তৈরি করেছিলেন। ব্রহ্মময়ী, কৃপাময়ী, আর ভবতারিণী। ব্রহ্মময়ী আর কৃপাময়ীর মূর্তি বরানগরের দুটি মন্দিরে অবস্থান করছেন। ভবতারিণী মায়ের মূর্তি দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে আর চতুর্থ ইচ্ছাময়ী মায়ের মূর্তি তাঁদের বাড়িতে অবস্থান করছেন। মূর্তিটি আকারে ছোট হলে হবে কি, শিল্পীর জাদু সব মূর্তিতেই সমান। মূর্তিটি নীল রঙ করা।  এখনো মা'কে তাঁরা ড্রাই ফ্রুটস দিয়ে পুজো দেন। আমরাও প্রসাদ পেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, ড্রাই ফ্রুটস কেন! আপনাদের মতো অনেকেই আসে, খোঁজ খবর করে। এমনি ফল তো বেশীক্ষণ রাখা যায় না। তাই। মায়ের নামে প্রায় ৬৫ বিঘে দেবোত্তর সম্পত্তি আছে। তাঁর বাবা বা ঠাকুর্দারা কাগজপত্র কিছুই ঠিকমতো গুছিয়ে রাখেন নি। এখন চেষ্টা করা হচ্ছে কাগজপত্রগুলো যদি কোনোভাবে উদ্ধার করা যায়।


বললেন দেউরির দিকে একটা ঘরে ভারতীয় ডাক বিভাগের অফিস আছে।

মায়াদেবী বলছিলেন, তাদের বংশেই রয়েছে শিক্ষার প্রতি অনুরাগ। যার ফলে এক সময়ে তাঁর তিন ঠাকুর্দার মধ্যে দুই ঠাকুর্দা, ডাক্তারি আর ওকালতি পড়তে বিদেশ চলে যান। তৃতীয়জন জমিদারি আর চাষবাস দেখাশোনা করতেন। বৈষয়িক বুদ্ধির অভাবে সুদের ব্যবসাটাও তখন নিম্নমুখী। ফলে মায়ের মূর্তিকে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর বিনা পুজোতে ঘর বন্দী করে রাখতে হয়। আর বাড়িটাও আর্থিক অনটনের কারণে ঠিকঠাক মেরামত করতে না পারায় ক্রমশ জীর্ন, ভগ্নদশা অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ দুর্গাপুজোও হতো নমো নমো করে।

তারপর বিংশ শতাব্দীর শুরুতে তারা তাদের মতো করে নিত্য পুজো শুরু করেন। আর কার্তিক মাসের দ্বীপান্বিতা অমাবস্যায় বাৎসরিক পুজো করা শুরু করেন। এখনো তাই চলছে। আমাদেরও আগামী কালীপুজোর সময় আসতে বললেন। ঘটনাচক্রে মায়াদেবীর শ্বশুরবাড়ী আর আমাদের দমদমের বাড়ির দূরত্ব খুব একটা বেশী নয়।


ধূলিমলিন জীর্ন শূন্য দুর্গাদালান দেখিয়ে বললেন দশ-বারো বছর আগেও আমরা কোনোরকমে দুর্গাপুজোটা টিঁকিয়ে রেখেছিলাম। পরবর্তী কালে স্থানীয় মানুষজন তাদের বাড়ির কাছেই পাকা দুর্গামণ্ডপ তৈরি করে সেখানে প্রতি বছর দুর্গাপুজো করছেন। আমরা ফেরার সময় দেখলাম সেই পুজো মণ্ডপ।

মায়াদেবী বলছিলেন, তিনি শুনেছেন এক সময় খুব ধুমধাম সহকারে এই আজকের এই  দুর্গামণ্ডপে দুর্গাপুজো হতো। যার গায়ে এখন সময়ের করাল থাবা। পঙ্খের কাজের ওপর বর্ষার জলের কালো ছোপ পড়ে গেছে।  পুরো বাড়িটার অবস্থাও তাই।  এখন সবটাই  অতীত।



ভালো থাকবেন সবাই।

Post a Comment

Previous Post Next Post