ছাতুবাবু-লাটুবাবুদের পুজোয় কুমারিপুজো করেন বাড়ির মহিলারা

0

ছাতুবাবু-লাটুবাবুদের পুজোয় কুমারিপুজো করেন বাড়ির মহিলারা

কলকাতা: সেকালের বাবু কালচার আর উত্তর কলকাতা এই দুটি নাম যেন পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। শোভাবাজার রাজবাড়ির সঙ্গে ছাতুবাবু লাটুবাবুদের বাড়ির ইতিহাস যেন শহর কলকাতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে রয়েছে। উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটের টুকটুকে লাল রঙের বাড়ির দুর্গাপুজোর ইতিহাস বহুদিনের। গেটের সামনে যে মূল থাম রয়েছে সেখানেই শ্বেতপাথরের ফলকে লেখা রামদুলাল দে এছাড়াও আরও দুইটি নাম লেখা ছাতুবাবু লাটুবাবু।

    প্রসঙ্গত, সেই সময় কলকাতার বাবু বলা পরিচিত ছিলেন এই দুই সদস্য ছাতুবাবু এবং লাটুবাবু। তবে পরিবারের প্রাণপুরুষ ছিলেন তাঁদের পিতা রামদুলাল দে, যাঁর হাত ধরে শুরু হয়েছিল পরিবারের দুর্গাপুজো। বাবু কালচার যেহেতু এই বাড়ির দুই সদস্যের মধ্যে খুব বেশি পাওয়া যায়, তাই এদের পুজোয় যাত্রা, কবিগান, বাঈ নাচ সমস্ত কিছুই হত। বিরাট ঠাকুরদালান, তারসাথে ঝাড়বাতির আলো যেন  বনেদিয়ানায় মোড়া বাড়িটির প্রতিটি স্থান। পুজোর সময় দেশ বিদেশ থেকে হাজারে হাজারে দর্শনার্থী ছুটে আছেন এনাদের বাড়ির পুজো দেখতে।

     হাটখোলা দত্তবাড়ির মদনমোহন দত্তের কর্মচারী হিসেবে ডুবন্ত কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজের নিলামে দত্ত বাড়ির হয়ে অংশ নিতে গিয়ে ব্যাপারে বিরাট দক্ষতা অর্জন করেন রামদুলাল দে। এর পর মদনমোহন দত্তের উৎসাহেই ব্যবসা শুরু করেন রামদুলাল। কথিত আছে, আমেরিকান ব্যবসায়ীদের সঙ্গে লেনদেন ছিল তাঁর। সদ্য স্বাধীন হওয়া আমেরিকা সেই সময় নিজেদের জন্য ব্যবসার ক্ষেত্র খুঁজছিল। ১৭৯০-এর মধ্যে আমেরিকার সঙ্গে ইংরেজ শাসিত ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্যের ভিত আর শক্ত হয়। সেই  সময় বস্টন, সালেম, ফিলাডেফিয়া, নিউ ইয়র্ক থেকে প্রচুর জাহাজ বাংলায় আসত। লোহা, ব্রান্ডি সহ নানা সামুদ্রিক মাছ, গরুর মাংস, মোমবাতি সব নিয়ে আসত। আর বিনিময়ে কলকাতা থেকে তারা নিয়ে যেত চা, চিনি, নীল এবং নানান বস্ত্র।

     আর এই কাজে আমেরিকানদের সাহায্য  করতেন দেশীয়বেনিয়াসম্প্রদায়। রামদুলাল দে ছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। মারা যাওয়ার সময় বিপুল সম্পত্তি তাঁর দুই সন্তান ছাতুবাবু এবং লাটুবাবুর জন্য রেখে গিয়েছিলেন। আশুতোষ দেব ওরফে ছাতুবাবু এবং প্রমথনাথ দেব ওরফে লাটুবাবুর সময়েই এই পুজোর জৌলুস আরও বৃদ্ধি পায়। এই দুই ভাই ছিলেন অতি শৌখিল। বুলবুলির লড়াই থেকে শুরু করে কুস্তির আখড়া, সবই ছিল তাঁদের নেশা। এঁদের আমলেই বাড়িটিকেও ঢেলে সাজানো হয়।

     প্রসঙ্গত, বাড়ির পুজো শুরু হয় রথের দিন কাঠামো পুজো করে এবং চণ্ডীর ঘট বসে  প্রতিপদ তিথি থেকে। বলাবাহুল্য, এই তিথি থেকে ষষ্ঠী অবধি পরিবারের গৃহদেবতা শালগ্রাম শিলাকে পুজো করা হয়। তৃতীয়াতে দেবীকে মূল বেদিতে বসানো হয়। একচালার মঠচৌড়ি আকৃতির সাবেকি প্রতিমায় দুর্গার পাশে লক্ষ্মী-সরস্বতী থাকেন না, মায়ের পাশে থাকেন তাঁর দুই সখী জয়া বিজয়া। অতীতে  পুজোর সময় পাঁঠাবলি হলেও একবার পাঁঠাকে বলি দেওয়ার সময় সেই পাঁঠাটি রামদুলাল দে মহাশয়ের কাছে ছুটে চলে আসায় সেই থেকে বলিদান বন্ধ করা হয়েছে বাড়িতে।

    উল্লেখ্য, ছাতুবাবু-লাটুবাবুদের পুজোতে কোন অন্নভোগ হয় না, তাই নৈবেদ্য দিয়েই  পুজো করা হয়। দেবীর সঙ্গে পঞ্চদেবতা, নবগ্রহ এবং ৬৪ দেবদেবীকেও পুজো দেওয়া হয়। তবে কুমারি পুজোর চল এখনও রয়েছে, বংশের বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলারা পুরোহিতের সাহায্যে এই কুমারিপুজো করেন। আগে দশমীতে বিসর্জনের সময় নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর প্রথা ছিল কিন্তু এই প্রথা এখন আর হয় না।

Article by: শুভদীপ রায় চৌধুরী

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)