দশমীর দিন গান গেয়ে, চোখের জলে মাকে বিদায় জানান চোরবাগান চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা
কলকাতা: ১৮৫৭ সাল, সিপাহী বিদ্রোহের সময় সমগ্র তখন ভারতে ব্রিটিশ রাজত্ব আর বঙ্গে বাবু কালচার জমজমাট, সে সময় উত্তর কলকাতার চোরবাগানে দুর্গাপুজো শুরু করেন রাজা রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৬০ সালে প্রথম পুজোর সূচনা হয় চ্যাটার্জি পরিবারে, চলতি বছর ১৬৪ বছরে পদার্পণ করতে চলেছে। এ বাড়িতে দেবীকে কন্যা রূপে পুজো করা হয়। তাই দুর্গাপুজোর সপ্তমীতে নবপত্রিকাকে বাড়িতেই স্নান করানো হয়।
প্রসঙ্গত, সেকালে চট্টোপাধ্যায় পরিবারে ঠাকুরদালানেই
প্রতিমা তৈরি হত, কিন্তু
বর্তমানে কুমোরটুলিতেই প্রতিমা তৈরি হয়। রথের
দিন প্রতিমা বায়না করে আসেন পরিবারের
সদস্যরা। চট্টোপাধ্যায় পরিবারের কাঠামো পুজো হয় জন্মাষ্টমী
তিথিতে। মহালয়ার পুণ্যতিথিতে দেবীর চক্ষুদান এবং দ্বিতীয়ার দিন
ঠাকুরদালানে দেবীকে নিয়ে আসা হয়।
ষষ্ঠীর দিন বোধন দিয়ে
শুরু হয় এই পরিবারে
দুর্গোৎসব, প্রথম যে রীতি মেনে
পুজো শুরু হয়েছিল সেই
একই রীতিতেই পুজো হয়ে আসছে
চট্টোপাধ্যায় পরিবারে। যারা প্রতিমা তৈরি
করেন তারাও বংশানুক্রমিক ভাবে তৈরি করে
আসছেন বলেই খবর। অতীতে
চ্যাটার্জী বাড়িতে পুজোর সময় নাটক মঞ্চস্থ
করার একটা চল ছিল।
সাবেকি একচালির প্রতিমায় দুর্লভ টানা চোখের উমা
হয় এই পরিবারে। শুরুতে
প্রতিমায় ডাকের সাজ দেওয়া হত।
তবে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন
দেবী পরেন বেনারসি, মাথায়
সোনার মুকুট এবং পরিবারের প্রাচীন
গহনায় সেজে ওঠেন তাঁরা।
দেবীর গায়ের রঙ সোনার মতন,
অসুর সবুজ এবং গণেশের
রঙ হালকা গোলাপি হয়। এ বাড়ির
প্রতিমার হাতে রুপোর পদ্ম
এবং অস্ত্র থাকে।
উল্লেখ্য, পুজোর এই চারটি দিন
আজও রাজ্য তথা গোটা দেশে
ছড়িয়ে থাকা সদস্যরা বাড়ির
পুজোয় সামিল হয়, চলে দেদার
হই হুল্লোড় ও পেটপুজো। প্রতিবারই
১০৮টি প্রদীপে সন্ধিপূজার আয়োজন করা হয় এই পরিবারে।
বলি বন্ধ হবার পর,
চিনির নৈবেদ্যে দান ও আম
এবং চালকুমড়ো বলির রীতি আছে
এই বংশে।
তবে চোরবাগানের এই চট্টোপাধ্যায় পরিবারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল দেবীর ভোগ। বাড়ির পুরুষ সদস্যরাই, বলাবাহুল্য যাদের উপনয়ন সম্পন্ন হয়েছে তারাই রান্না করে দেবীকে ভোগ নিবেদন করেন। এই পরিবারের পুর্বপুরুষরা যে রীতি অনুযায়ী সপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী এবং দশমীতে কী কী ভোগ হবে তা বর্ণনা করে গিয়েছেন আর বর্তমান সদস্যরাও সেই রীতি মেনেই ভোগ রান্না করে আসছেন। ভোগে থাকে সাদাভাত, খিচুড়ি, সাতভাজা, আলুপটলের কালিয়া, পোনামাছ ভাজা, শুক্তা, চাটনি, মাছ, পায়েস এবং মিষ্টি ইত্যাদি। এছাড়া সপ্তমীতে লাউচিংড়ি, অষ্টমীতে শাকের ঘন্ট, নবমীতে ভেটকিমাছের ঘন্ট, চিংড়িমাছের মালাইকারি ইত্যাদিও নিবেদন করা হয়। দশমীর দিন এখানে রন্ধন হয় না, একেই বলে দুর্গারন্ধন, অর্থাৎ বাসি ভোগ দেওয়া হয়। ছাঁচিকুমড়া, ইলিশ মাছের অম্বল এদিনের বিশেষত্ব। এছাড়া সন্ধিপুজোতে লুচি, মিষ্টি, বোঁদে, আর দশমীতে দধিকরমা, বাসি লুচি ও সন্দেশ।
বলাবাহুল্য, দশমীর দিন দর্পনে বিসর্জনের পর বিকালে প্রতিমা বিসর্জনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। দেবী বরণের পর বাড়ির মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে রওনা দেন বাড়ির সদস্যরা। তবে দশমীর দিন এই পরিবারের প্রতিটি সদস্য দেবীকে একটি গান গেয়ে বিদায় জানান, যেটি পরিবারের চিরাচরিত প্রথা। “ভজিতে তোমারে শিখি নাই কভু, ডাকি শুধু তোমায় মা বলে”-চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সমস্ত সদস্যরা কন্ঠ মেলান এই গানে। ঐতিহ্যের মেলবন্ধন এমনই যে, প্রাচীন ধারাকে আজও নবীন প্রজন্মের সদস্যরা শ্রদ্ধার সাথে পালন করে চলেছেন।
Article by: শুভদীপ রায় চৌধুরী