কোন জন্মদিন নেই শহর কলকাতার
২৪ শে আগস্ট- এই দিনটিকে কেন্দ্র করে প্রতিবারই কমবেশি হুজুগে মানুষের মধ্যে এক অলিখিত উন্মাদনা কাজ করে। সেই অবাস্তব উন্মাদনটি হল- 'আজ কলকাতার জন্মদিন'! কিন্তু বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা করলে সহজেই বোঝা সম্ভব যে, কোন শহরের একটি নির্দিষ্ট দিনকে জন্মদিন বলে চিহ্নিত করা যায় না। কারণ, যে কোন শহর গড়ে ওঠে তার ধারাবাহিক সামাজিক পটপরিবর্তনের মধ্যদিয়ে। এছাড়া সেই অঞ্চলে বসবাস করা মানুষের কৃষ্টির মাধ্যমে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে একটি শহর। ঠিক তেমনই কলিকাতা থেকে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে শহর কলকাতা। আর এই গড়ে ওঠার পিছনে কোন বহিরাগত বিদেশী শক্তির ভুমিকা নেই।
শহর কলকাতার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে হাজার হাজার বছরের সুপ্রাচীন ইতিহাস। সেই দীর্ঘদিনের ধারাবাহিকতা একদিন বদলে ফেলা সম্ভব নয়। সেই কারণেই কলকাতা হাইকোর্টে দায়ের হওয়া এক জনস্বার্থ মামলায় আদালত ২০০৩ সালের ১৬ মার্চ তারিখে রায়ে জানিয়ে দেয় যে, কলকাতার কোনও জন্মতারিখ নেই এবং কোনও প্রতিষ্ঠাতাও নেই। অর্থাৎ, হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিদের রায়ে সুস্পষ্টভাবে উঠে আসে যে, দীর্ঘদিন ধরে বেশকিছু ইতিহাসবিদ দাবি কলকাতার জন্মতারিখ হিসাবে অভিহিত ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অগাস্ট তারিখটি উল্লেখ করে চলেছেন তা মটেই সত্য নয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই 'কলকাতা' নামের উৎপত্তি কবে? সেই ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই কলকাতার ব্যাপ্তি বা কত প্রাচীন এই শহর তা অনুধাবন করা সম্ভব। আইন-ই-আকবরি’র রাজস্ব আদায়ের খতিয়ানে ‘কলিকাতা’ নামের উল্লেখ রয়েছে। আবার ১৪৯৫ সালে বিপ্রদাস পিপলাইয়ের ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে, কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ কলিকাতার উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া, ওলন্দাজ বণিক ফান ডেন ব্রুক-এর অঙ্কিত মানচিত্রেও কলকাতার উল্লেখ আছে। ‘পদ্মাবতী’র রচনাকাল আনুমানিক ১৬৪৫-৫২ সাল- সেই গ্রন্থেও কলকাতা রয়েছে। এমনকি গুরু নানকের জীবনীতে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে, ১৫১০ সালে কালীক্ষেত্র দর্শন করতে এসে নানক কলকাতায় বসবাস করেছেন। তাছাড়া, ২৪ শে আগস্ট কলকাতার জন্মদিন- এই তথ্য ভ্রান্ত বলে উল্লেখ করেন ইতিহাসবিদ রাধারমণ রায়। ১৯৯১ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ‘কলকাতা বিচিত্রা’। সেই বইটিতেই তিনি স্পষ্ট উল্লেখ করেন যে, ২৪ আগস্ট ১৬৯০ তারিখটি কলকাতার জন্মদিন নয়, আর জোব চার্নকও কলকাতার জন্মদাতা নন। এর পাশাপাশি, ১৬০৮ সাল থেকে কলকাতা সহ আর বেশকিছু পরগনার জমিদার ছিলেন সাবর্ণ চৌধুরীদের বংশধরেরা। জমিদার লক্ষ্মীকান্ত রায় চৌধুরী কলকাতায় নব সমাজপত্তন থেকে শুরু করে, কুসংস্কার প্রথা রদ করা, দ্বিতল পাকা বাড়ি নির্মাণ, আধুনিক রাস্তা নির্মাণ এমনকি বিজ্ঞানসম্মতভাবে সুতানুটিকে ব্যাবসাকেন্দ্র রূপে গড়ে তুলতে শুরু করেছেন। তাই কলকাতা হাজার হাজার বছরের প্রাচীন তা বলতে কোন দ্বিধা নেই। এবার বলি, কলকাতার জনক হিসাবে জোব চার্ণককেও বাতিল করেছে কলকাতা হাইকোর্ট।
কারণ
১৬৯০-এর ২৪ অগস্টের
আগে আরও দু'বার
চার্ণক এসেছেন সুতানুটিতে, আবার চলেও গিয়েছেন
অন্যত্র। প্রথম ১৬৮৬-র ডিসেম্বরে,
তার পর ১৬৮৭-র
নভেম্বরে। কিন্তু এই তৃতীয়বার এসে
পাকাপাকি ভাবে এখানেই থেকে
যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। বলা বাহুল্য যে,
১৬৮৬ সালের ২৮ অক্টোবর যে
যুদ্ধ হয়েছিল হুগলির বাজারে, সেই যুদ্ধে জোব
চার্নকের বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন নবাব।
তাই তিনি পালিয়েই এসেছিলেন
সুতানুটিতে। তাছাড়া চার্নক যেখানে আস্তানা গড়েছিলেন সেটা ছিল সুতানুটি,
কলকাতা নয়। কলকাতায় কোনদিনই
জোব চার্ণক আসেননি বরং তিনি তৃতীয়বার
কলকাতায় যখন আসেন তখন
গুপ্তরোগে আক্রান্ত ছিলেন এবং তাঁর অবস্থা
বড়োই শোচনীয় ছিল। প্রায় দু’শো লোক তখন জ্বরে
ও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত। তার ওপর তিনিও
আক্রান্ত। শেষ বয়সটা সুতানুটিতে
কাটিয়ে তাঁর জীবনের পরিসমাপ্তি
ঘটেছিল।
তাই
সেই সময় কলকাতায় আসার
কোন প্রশ্নই ওঠে না।
তাছাড়া, এনসাইক্লোপিডিয়ায় প্রকাশিত হয় এক ছবি, নীচে জোব চার্নকের নাম। তবে এই ছবিটি কি সত্যই জোব চার্নকের? যদিও হয় তা হলে সেই সময় তাঁর বয়স কত ছিল? এ রকম বিভিন্ন প্রশ্নই উঠতে শুরু করে এবং গবেষকদের কলমে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে জোব চার্নককে নিয়ে এবং তাঁর বিভিন্ন কার্যকলাপ নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। সেই বিতর্কিত মানুষটিকে আদৌ কলকাতার জনক বলা যায়?তবে ভারতে কবে প্রথম পা রেখেছিলেন তা সঠিক জানা যায় না। আর পাটনা কুঠির অধ্যক্ষ থাকাকালীন তাঁর বয়স ঠিক কত ছিল, সে সম্পর্কেও কিছু তথ্য নেই। তাঁর সঠিক জন্মতারিখ কোথাও রেকর্ড করা নেই। জানা যায় যে জোবের দাদা স্টিফেনের জন্ম ১৬২৮ সালে। কেউ কেউ অনুমান করেন যে স্টিফেনের চেয়ে জোব তিন বছরের ছোটো ছিলেন। তা হলে জোবের জন্মসাল ১৬৩১-এর আশেপাশে। সেই হিসাব ধরলে ১৬৬৪ সালে তাঁর বয়স দাঁড়ায় তেত্রিশ- এও অনুমানভিত্তিক।
তাই সাম্রাজ্যবাদের ঢাক-ঢোল পিটিয়ে চার্নককে কলকাতার জনকের আসনে বসানোর যত অপচেষ্টাই করা হোক না কেন, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করবেনই।
Article by: শুভদীপ রায় চৌধুরী