রাজা রামব্রহ্মের স্বপ্নাদেশেই শিবপুরে শুরু হয় শারদীয়া দুর্গাপুজো
হাওড়া: দুর্গাপুজো মানেই বাঙালির নস্টালজিয়া, দীর্ঘদিনের উন্মাদনা এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। বারোয়ারি পুজোর পাশাপাশি বছরের পর বছর ধরে চলা বনেদি বাড়ির ঠাকুরদালান জানান দেয়, বাংলার দুর্গোৎসব বহুদিনের। পুজোর দিনগুলিতে বনেদি বাড়িতে ভিড় করেন দেশ বিদেশের দর্শনার্থীরা। বর্তমানে থিম পুজোর বিজ্ঞাপনের ভিড়ে বনেদি বাড়ির জৌলুস হারিয়ে গেলেও প্রাচীন রীতিনীতি মেনে পুজো করতে বধ্যপরিকর বংশের বর্তমান প্রজন্মের সদস্যরা। তেমনই এক শতাব্দী প্রাচীণ বনেদি বাড়ির পুজোর ইতিহাস রইল এবারের প্রতিবেদনে
প্রসঙ্গত, কলকাতার পাশাপাশি হাওড়াতেও বহু প্রাচীন বনেদি
বাড়ি রয়েছে, যাদের কোনটির বয়স ৩০০ বছর
আবার কোনটি ৪০০ বছরেরও প্রাচীন।
তবে তাদের মধ্যে অন্যতম শিবপুরের রায়চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজো। এ বাড়ির পুজো
শুরু হয় ১৬৮৫ সালে,
সূচনা করেন বংশের সুসন্তান
রাজা রামব্রহ্ম রায় চৌধুরী। মূলত,
স্বপ্নে দেবীর আদেশ পেয়েই এই পুজো শুরু
হয়। পুজোর সেকালের সেই রাজকীয় জৌলুস
হয়তো নেই, তবে নিয়ম,
নিষ্ঠা যথাসম্ভব বজায় রেখে চলেছেন
‘শ্রী শ্রী দূর্গা-কালীমাতা
এসেস্ট’- এর
বংশধরেরা।
এই বংশের দুর্গাপুজো
সূচনার এক কাহিনী রয়েছে।
কথিত আছে, এ বাড়ির
রাজকন্যা বাড়ির কাছেই বালি পুকুরে রোজ
দুপুরে পদ্মাবতী নামে একটি মেয়ের
সঙ্গে খেলা করতেন। খেলা
শেষে পুকুরে নেমে স্নানও করতেন।
এদিকে রাজা রামব্রহ্ম রায়চৌধুরী
মেয়ের এই কথা জানতে
পেরে রেগে যান। কে
সেই খেলার সঙ্গিনী? কেন রাজকন্যাকে পুকুরে
স্নান করতে বলে? কোথায়
থাকে সেই সঙ্গিনী? এই
সব জানতেই রাজকন্যা মারফত তাঁর সঙ্গিনীকে ডেকে
পাঠান রাজা। বিষয়টি জেনে রাজকন্যের বান্ধবী
সাফ জানান, তিনি রাজার নির্দেশ
মানবেন না। বিষয়টি জেনে
সেদিনই রাজা তাঁর পেয়াদাদের
পাঠান পুকুর থেকে পদ্মাবতীকে খুঁজে
নিয়ে আসতে। কিন্তু পেয়াদারা ওই পুকুরে গিয়ে
দেখেন পুকুর ধারে শুধু পায়ের
ছাপ, সেখানে কেউ নেই।
সেদিন পেয়াদারা ফিরে যান রাজ
দরবারে। আর রাতেই রাজা
রামব্রম্ভকে স্বপ্ন পান। স্বপ্নে দেবী
রাজাকে বলেন, পদ্মাবতী আসলে দেবী দুর্গা।
তিনি রাজকন্যার বন্ধু রূপে রোজ দুপুরে
বালি পুকুরে তাঁর সঙ্গে খেলা
করেন। তাঁর পুজো যেন
শিবপুরের রায় চৌধুরী পরিবারে
হয়। উল্লেখ্য, রায়চৌধুরী পরিবারের এই ঠাকুরদালান শিবপুরে
‘সাঁজের আটচালা’ নামেই পরিচিত। সাবেকি একচালার ডাকের সাজের প্রতিমায় টানাচৌড়ি আকৃতির চালচিত্র- এই পুজোর বিশেষ
বৈশিষ্ট্য। আটচালায় মায়ের বোধন হয় কৃষ্ণনবমীতে।
সদিন থেকেই রায় চৌধুরী পরিবারের
পুজোর সূচনা। এ বাড়ির পুজো
হয় বৃহন্নন্দীকেশ্বর পুরাণ মতে।
ঠাকুরদালানেই তৈরি হয় এ
বাড়ির প্রতিমা। আর দো-মেটে
সম্পন্ন হওয়ার পরে এখনও এলাকার
বহু ব্রাহ্মণ আমন্ত্রিত হন এই বাড়িতে।
মায়ের মূর্তি দর্শন করে তাতে কোনও
ত্রুটি আছে কি না
তা দেখেন এবং সঠিক ছাড়পত্র
পাওয়ার পরেই শুরু হয়
প্রতিমা নির্মাণের চূড়ান্ত কাজ।
বলাবাহুল্য, এ বাড়ির পুজোয়
প্রতিমার সামনে
কোনও ঘট বাঁধা হয়
না। ঘট বসে চণ্ডীর
ঘর সংলগ্ন একটি বেলগাছে। উল্লেখ্য
যে, এই বেল-ঘরের
ছাঁদ ফুড়ে গাছটি উঠে
গিয়েছে। পরিবারের বিশ্বাস যে, এই বেলগাছ
দিয়েই মর্তে উমার আগমন হয়।
পুজোতে এখনও বলি প্রথা
চালু আছে। অতীতে সপ্তমীতে
৭টি, অষ্টমীতে ৮টি এবং মহানবমীতে
৯টি বলিদানের রীতি ছিল। তবে,
বর্তমানে সপ্তমীর দিন একটি এবং
মহাষ্টমী ও নবমীর দিন
দুটি করে পাঁঠা বলি
হয়।
এ বাড়িতে পুজোয় দেবীকে আমিষ ভোগ নিবেদন করা হয়। এছাড়া নানান মিষ্টান্ন, নারকেল নাড়ু, বিভিন্ন রকম ফল দিয়ে নৈবেদ্য তৈরি হয়। দশমীতে পুজোর শেষে দেবীর ঘট কিংবা মায়ের মুকুট— কোনটিরই বিসর্জন হয় না। দেবী বরণের পর মায়ের মুকুট বংশের মন্দির ব্যাতাই চন্ডীর মাথায় পরানো হয়, এটাই এই বংশের প্রাচীন রীতি।
Article by: শুভদীপ রায় চৌধুরী