যদি ভুলে যাও মোরে, জানাব না অভিমান.....

0

 যদি ভুলে যাও মোরে, জানাব না অভিমান.....

কলকাতা: বাংলা সঙ্গীতের জগতে তাঁর নাম চিরস্মরণীয়। আধুনিক বাংলা গানের শ্রষ্ঠা, পাশাপাশি সাহিত্যিক হিসাবেও যাঁর অবদান অনস্বীকার্য- তিনি গীতিকবি প্রণব রায়, আজ তাঁর প্রয়াণ দিবস। উল্লেখ্য, বাইশে শ্রাবণ এলেই কবিগুরুর পাশাপাশি মনে পড়ে গীতিকার প্রণব রায়ের কথা। রচনা করে গিয়েছেন সাড়ে তিনহাজার বাংলা গান, যা এক ইতিহাস। বড়িশার সাবর্ণ রায় চৌধুরী বংশের সুসন্তান এবং বিজ্ঞানে স্নাতক প্রণব রায় নানা বৃত্তি উপেক্ষা করে গান লেখাকেই পেশা করেছিলেন। একসময়ে বলতেন, “আমার পকেটে একটা কলম এবং এক টুকরো কাগজ থাকলেই আমি ভাবতাম আমার সঙ্গে হাজারটা টাকা আছে।”

     ১৯১১ সালের ৫ই ডিসেম্বরে বড়িশার সাবর্ণ চৌধুরীদের বংশে জন্ম তাঁর, পিতা দেবকুমার রায় চৌধুরী। কলকাতার ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সিটি কলেজে ভর্তি হন। সেখানেই বিএ পড়ার সময় ‘কমরেড‘ কবিতার জন্য তাঁর কারাবাস হয়। কারাবাসের কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সমাপ্তি ঘটে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাবশিষ্য ছিলেন এবং কলেজ জীবনে স্বদেশী আন্দোলনে অংশ নেন। ‘বিশ্বদূত‘ পত্রিকায় তিনি প্রথম ‘কমরেড‘ শীর্ষক এক কবিতা লেখেন এবং সেজন্য তাঁকে কারাবাস করতে হয়। তাঁর রচিত চারটি গান নজরুল ইসলামের অনুমোদনে ১৯৩৪ সালে শারদীয় হিজ মাস্টার্স ভয়েস রেকর্ডে প্রথম প্রকাশিত হয়। HMV-র রেকর্ড ক্যাটালগে লেখা হয়, “আমরা এবার এক তরুণ সঙ্গীত রচয়িতাকে পেয়েছি যিনি এসেছেন নব নক্ষত্র উদয়ের বিস্ময় নিয়ে। ইনি প্রণব রায়। এঁর লেখা গান যে কোনও শ্রেষ্ঠ গীতরচয়িতার গানের পাশে সসম্মানে সমান আসন দাবি করতে পারে।”

     উল্লেখ্য, কিংবদন্তি সুরকার কমল দাশগুপ্তের সঙ্গে প্রণব রায়ের তৈরি হয় চিরকালের অমর জুটি। গীতিকবির রচিত ‘সাঁঝের তারকা আমি’ ও ‘আমি ভোরের যূথিকা‘ গান দুটি যূথিকা রায়ের কণ্ঠে সমানভাবে জনপ্রিয়তা পায়। এই গান গেয়ে যূথিকা রায় যেমন জনপ্রিয় শিল্পী হয়ে ওঠেন, তেমনিই গীতিকার হিসাবে প্রণব রায়ের খ্যাতিও বাড়ে। ১৯৩৬ সালে ‘পণ্ডিত মশাই’ ছায়াছবিতে কমল দাশগুপ্তের সুরে প্রথম গান রচনা করেন তিনি। তবে জগন্ময় মিত্রের কণ্ঠে প্রণব রায়ের লেখা ‘চিঠি’ ও ‘সাতটি বছর আগে পরে‘ এই গল্পগীতি এতটাই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে, তা বলার অপেক্ষাই রাখে না।

     বলাবাহুল্য, আকাশবাণী ও ছায়াছবির গান লেখার পাশাপাশি সহকারি পরিচালক হিসাবেও কাজ করতে শুরু করেন তিনি। তাই গীতিকবি হলেও, তিনি ছিলেন একাধারে চিত্রনাট্যকার, কাহিনীকার, অভিনেতা এবং চলচ্চিত্র পরিচালক। ১৯৪৬ সালে 'সাত নম্বর বাড়ি' ছায়াছবির জন্য প্রথম চিত্রনাট্য লেখেন। এরপর হারজিত (১৯৫৭), পিতাপুত্র (১৯৬৯), পরিণীতা (১৯৬৯) ইত্যাদি ছবির জন্যও চিত্রনাট্য লিখেছিলেন তিনি। এর পাশাপাশি, ব্রাহ্মণ কন্যা (১৯৪১), ফাগুন (১৯৫৮), ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিসটেন্ট (১৯৭১) ইত্যাদি ছবির কাহিনীকার ছিলেন প্রণব রায়।

    চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবে তাঁর উল্লেখ্যযোগ্য অবদান- রাঙামাটি, অনুরাধা, প্রার্থনা ইত্যাদি। স্বর্ণযুগের বেশিরভাগ ছায়াছবির গীতিকার ছিলেন তিনি, একের পর এক মাইলস্টোন রচনা করেছেন এবং তৈরি করেছেন এক ইতিহাস। পৃথিবী আমারে চায়, সাহেব বিবি গোলাম, পরিণীতা, পিতাপুত্র, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, বৈকুণ্ঠের উইল, ভোলা ময়রা, কলঙ্কিত নায়ক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৫ সালে Best Indian Cinema (1964) নিরিখে সেরা গীতিকারের পুরস্কার পান তিনি। তবে কোনদিনই পুরস্কারের প্রতি লোভ ছিল না তাঁর। বরাবরই বলে গিয়েছেন, 'ভিখিরী আমার গান গেয়ে ভিক্ষে চাইছে- এর থেকে বড় পুরস্কার কী?'

    কিংবদন্তী গায়ক-সুরকার কৃষ্ণচন্দ্র দে এবং  সুরসাধক হিমাংশু দত্তের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আসে তাঁর। ১৯৪১ সালে পরিচালক নীতিন বসু ও সুরকার রাইচাঁদ বড়াল 'পরিচয়'  ছবির জন্য রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে একটি গান লেখানোর চেষ্টা করেন। তখন রবীন্দ্রনাথ নিজেই প্রণব রায়ের নাম প্রস্তাব করেন। এই অভূতপূর্ব সুযোগ পান প্রণব রায়। রাইচাঁদের সুরে সায়গল সাহেবের গলায় সেই গান তাঁকে অনন্য সম্মান দেয়। ১৯৪২ সালে প্রমথেশ বড়ুয়া-কাননদেবী অভিনীত ছবি 'শেষ উত্তর'-এর জন্য লিখলেন 'আমি বনফুল গো'। ১৯৭৫ সাল অবধি দাপটের সঙ্গে কাজ করেও  পরবর্তীকালে আশা ভোঁসলে, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, অনুপ ঘোষালের মতন বহু বিখ্যাত শিল্পীর কণ্ঠের জন্যও গান লিখে গিয়েছেন। বাংলা ছায়াছবি এবং গানকে আর কয়েকশো বছর এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই প্রণব রায়ের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, যা বলার অপেক্ষা রাখে না।

Article by: শুভদীপ রায় চৌধুরী

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)