রামমোহন থেকে বিদ্যাসাগর, রাসমনির পুজোয় উপস্থিত থাকতেন বিশিষ্ট অতিথিরা
কলকাতা:
দক্ষিণ কলকাতার নামজাদা বনেদি পরিবারগুলির অন্যতম জানবাজারের রাসমনির পরিবার। বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক নবজাগরণে এই বংশের ভূমিকা
উল্লেখযোগ্য। জানবাজারের রাসমনি বাড়ির দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন রানীর শশুর
প্রীতিরাম দাস, ১৭৯০ সালে।
চলতি বছর এই বাড়ির
পুজো ২৩৫ বছরে পদার্পণ
করল। পরবর্তীকালে
(১৮৩৬ সালে)এই পূজোর
দায়িত্ব নিজেই গ্রহণ করেন রাসমনি। পরিবার
সূত্রে খবর, একসময় রাজা
রামমোহন রায় থেকে শুরু
করে বিদ্যাসাগরের মতন মহান ব্যাক্তিত্বের
আগমণ ঘটত এই বাড়ির
দুর্গাপুজোয়। একচালার সাবেকি প্রতিমায় দেবী মূর্তিটি সম্পূর্ন
ভাবে হাত দিয়ে গড়া
হয় কোন ছাচে নয়।
প্রতিপদ থেকে বোধন
বসে একং আটদিন ধরে
পুজোর পর ষষ্ঠীর দিন
হয় মায়ের চক্ষুদান। অতীতে সপ্তমী থেকে নবমী অবধি
ছাগবলীর প্রথা ছিল, তবে বর্তমানে
বন্ধ।
উল্লেখ্য, আমতার ঘোষালপুর গ্রামে প্রীতরামের আদি বাসস্থান। ছোটো
বয়সেই অভিভাবকহীন
হয়ে ছোট দুই ভাইকে
নিয়ে জানবাজারে এক জমিদার আত্মীয়ের
বাড়িতে উঠে আসেন তিনি।
এই জমিদার পরিবারের এক সদস্য ডানকিন
সাহেবের দেওয়ান ছিলেন। বেলেঘাটায় ছিল তাঁর নুনের
কারবার। সেখানেই মুহুরীর কাজ পেয়েছিলেন প্রীতরাম।
কিন্তু হঠাৎই ভাগ্যবিপর্যয় হল, মারা গেলেন
ডানকিন সাহেব। সেই সময় প্রীতরাম
অন্য ভাবে শুরু করলেন
রোজগার। প্রথমে বাঁশের ব্যবসা সেখান থেকে জেলাশাসকের সেরেস্তায়
চাকরি, আর নাটোরের স্টেটের
দেওয়ানের কাজ। সেই সঙ্গে
করলেন আরও অনেক কিছুই।
ততদিনে বাংলার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজিও আয়ত্ত করে ফেলেছেন প্রীতরাম।
১৮০০ সালে নাটোর
রাজের অধীনস্থ মকিমপুর ১৯ হাজার টাকায়
কিনে নিলেন। সে সময়েই কলকাতায়
শুরু করলেন কিছু ব্যবসা। জানবাজারে
তৈরি করলেন সাতমহলা বাড়ি। তখনকার যুগে প্রাসাদসম এই
বাড়ি তৈরি করতে খরচ
হয়েছিল ৫ লক্ষ টাকা,
আর সময় লেগেছিল প্রায়
দশ বছর।
বলাবাহুল্য, বাড়ি তৈরির আগেই
প্রীতরাম ঠিক করেন, এখানে
দুর্গাপুজো করবেন। পুত্রবধু রানি রাসমনি যখন
পুজোর দায়িত্ব নেন, তখন পুজোর
রমরমা আরও বৃদ্ধি পায়।
সেকালে পুজোয়
খরচ হত ৪০-৫০
হাজার টাকা। পুজোর সময় ঠাকুরদালানে পুরাণ,
চণ্ডীপাঠ, রামায়ণ,
মহাভারত এবং গীতাপাঠও হত।
একসময়ে এ বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণদেব
সখীবেশে চামর দুলিয়ে দেবীর
পুজো করেন।
অতীতে রাসমনির পুজোতে যাত্রা, পালাগানের পাশাপাশি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল দশমীর দিন
কুস্তি প্রদর্শনী। দেশ বিদেশের কুস্তিগীরেরা
আসতেন। শক্তি প্রদর্শনীতে বিজয়ীদের ৫০- ২০০ টাকা
পর্যন্ত পুরস্কার দেওয়া হত।
উল্লেখ্য, এ বাড়িতে কাঠামো
পুজো হয় রথের দিন।
এক চালার প্রতিমার পরনে থাকে ডাকের
সাজ। ২২ ফুটের প্রতিমার
গায়ের রং হয় শিউলি
ফুলের বোঁটার মতো, সরস্বতীর মুখ সাদা,
অসুরের মুখ সবুজ। ষষ্ঠীর
দিনই দেবীর হাতে অস্ত্র দেওয়া
এবং গয়না পরানো হয়।
সপ্তমীর দিন বাড়ির সমস্ত
দেবতাকে ঠাকুর দালানে নিয়ে আসা হয়।
বাড়ির মহিলারা রাসমনির সময় থেকেই অন্দরমহলের
একটি বিশেষ সিঁড়ি দিয়ে যাতায়াত করেন।
সপ্তমী, অষ্টমী এবং মহানবমী এই
তিনদিনই কুমারী পুজো হয়।
এ বাড়িতে ভোগে
লুচি, নানান ভাজা ও ঘরের
তৈরী খাজা, গজা, প্যারা ইত্যাদি
মিষ্টি দেওয়া হয়। অতীতে সন্ধিপুজোয়
৪০ মন চালের নৈবেদ্য
দেওয়া হত, বর্তমানে ১মন চালের
নৈবেদ্য দেওয়া হয়।
দশমীর দিন সকালে ঘটে বিসর্জনের পরে সকালেই সারা হয় বিজয়াপর্ব। প্রতিমার পায়ে আলতা দেন বাড়ির মহিলারা। দেবী বিদায়ের আগেই শেষ করে রাখা হয় রান্নার কাজ। বিসর্জনের পরদিন অরন্ধন দিবস পালন করা হয়।
Article by: শুভদীপ রায় চৌধুরী