শ্রীরাধারমণকে ফিরে পেতেই শান্তিপুরের বড় গোস্বামী বাড়ির সদস্যরা শুরু করেন কাত্যায়নী পূজা

0

 শ্রীরাধারমণকে ফিরে পেতেই শান্তিপুরের বড় গোস্বামী বাড়ির সদস্যরা শুরু করেন কাত্যায়নী পূজা

শান্তিপুর: বাঙালির আবেগের উৎসব শারদোৎসব। আর এই পুজোকে কেন্দ্র করে আট থেকে আশি সকলের উন্মাদনা চোখে পড়ার মতন। বিভিন্ন বনেদি বাড়ির পাশাপাশি  বারোয়ারী মণ্ডপেও ভেসে ওঠে উৎসবের আনন্দে। বারোয়ারীতে বা ক্লাবগুলিতে থিমের চমকের পাশাপাশি জমিদারবাড়িগুলির পুজোর মূল আকর্ষণই হল সাবেকিয়ানা। তেমনই এক বনেদি বাড়ি হল শান্তিপুরের বড় গোস্বামী বাড়ি। বাড়ির পুজোর বয়স চারশো বছরেরও বেশি। এখানকার পূজিতা দেবী হলেন কাত্যায়নী।

     প্রসঙ্গত, একসময়ে বাড়ির মন্দির থেকে উধাও হওয়া শ্রীরাধারমনকে ফিরে পেতেই কাত্যায়নী পুজো শুরু করা হয়েছিল বড় গোস্বামী বাড়িতে, এবং আজও সেই প্রাচীন রীতিনীতি অক্ষুণ্ণ রেখেই দুর্গাপুজো করেন পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের সদস্যরা।ষোড়শ শতাব্দীতে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বাবা রঘুরাম রায়ের রাজচলছে। সেই সময় শান্তিপুর নাথ শ্রী অদ্বৈত আচার্য্যর পুত্র বলরাম মিশ্রের পুত্র মথুরেশ গোস্বামী থেকেই তৈরি হয় বড়ো গোস্বামী বাড়ি। কমলাক্ষ (অদ্বৈত প্রভুর বাল্য নাম) পিতৃমাতৃহীন হয়ে যখন আধ্যাত্মিক চেতনা লাভের জন্য তীর্থ দর্শনে বের হন তখন অধুনা নেপালের গন্ডকী নদী থেকে এক নারায়নশীলা প্রাপ্ত হন যেটি অপ্রকটের পূর্ব পর্যন্ত তাঁর নিত্য সঙ্গী ছিল। অপ্রকটের ঠিক পূর্ব মূহুর্তে সেই শিলার সেবাভার দান করেন বলরাম মিশ্রকে।  এখনও অবধি সেই শালগ্রামশিলা বড় গোস্বামী বাড়িতেই পূজিত হন।

    উল্লেখ্য, মথুরেশ গোস্বামী, তাঁর বাবার থেকে রাধা মদনমোহন বিগ্ৰহ এবং প্রভু সীতানাথ, সীতামাতা এবং অচ্যুতানন্দের সেবাভারও পান। বলাবাহুল্য, এই মথুরেশ গোস্বামীর প্রথম পুত্র রাঘবেন্দ্র গোস্বামী থেকেই বড়ো গোস্বামী বাড়ির সৃষ্টি।

     পরিবার সূত্রে খবর, কষ্টিপাথরের তৈরি এই কৃষ্ণ বিগ্রহ (শ্রীরাধারমণ) এক সময়ে পূজিত হতেন পুরীতেদোলগোবিন্দনামে। সেই বিগ্রহ পরে বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম বসন্ত রায় নিয়ে যান যশোরে। বসন্ত রায়ের গুরু ছিলেন মথুরেশ গোস্বামী। তবে মানসিংহের বাংলা আক্রমণের সময়ে, যাতে কিছুতেই পাঠান সেনারা বিগ্রহ নষ্ট করে না দেয় সেই ভয়ে এবং তিনি ক্ষত্রিয় হওয়ার কারণে এই বিগ্রহের সেবাভার দেন অদ্বৈতাচার্যের প্রপৌত্র তথা বড় গোস্বামী বাড়ির পূর্বপুরুষ মথুরেশ গোস্বামীকে। তিনিই সেটি নিয়ে আসেন শান্তিপুরের বসত বাড়িতে। একসময় পরিবারের প্রতিষ্ঠিত সেই রাধারমণ বাড়ির মন্দির থেকে উধাও হয়ে যান। সেই বিগ্রহ ফিরে পেতেই বাড়ির মহিলারা ব্রত করেন দেবী কাত্যায়নীর। কারণ বৃন্দাবনের  গোপীরা কাত্যায়নীব্রত করেই  লীলাপুরুষোত্তমকে পেয়েছিলেন। ঠিক তেমনই  তাঁদেরও বিশ্বাস ছিল যে শ্রী রাধারমণকে ফিরে পাবেন দেবীর পূজা করলে এবং পুজোর সময় স্বপ্নাদেশে জানা গেল, বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই রয়েছেন শ্রীরাধারমণ। তখন বড়ো গোস্বামীর  সদস্যরা তাঁকে নিয়ে আসেন।

    এই বনেদি বাড়ির বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে,  বাড়িতে দেবীর বাহন সিংহ ঘোটকাকৃতি অর্থাৎ বৈষ্ণব সিংহ। সাবেকি একচালির প্রতিমায় দেবীর দশটি হাতের মধ্যে দুটি হাত বড়, আটটি হাত ছোটো। সম্পূর্ণ বৈষ্ণব মতে পুজো হয় বাড়িতে। দেবীর ডান দিকে থাকে কার্তিক লক্ষ্মী এবং বাম দিকে গণেশ সরস্বতী। এই বাড়ির দুর্গাপুজো পুজো হয় পূর্বপুরুষদের তৈরি করা বিশেষ পুথি দেখে।   মহানবমীতে হয় বিশেষ প্রার্থনা।এই বাড়িতে ভোগরান্না করেন বাড়ির দীক্ষিত মহিলারাই।

   বিষয়ে কথা হল পরিবারের সদস্য সুদীপ্ত গোস্বামীর সঙ্গে। তিনি জানান, এই বাড়িতে দেবীকে ৩৬ রকমের পদ দিয়ে ভোগ দেওয়া হয়। ভোগে থাকে সাদা ভাত, খিচুড়ি, নানান ভাজা, শুক্তানি, তরকারি, পোলাও, ধোঁকার তরকারি, ছানার ডালনা, পায়েস, চাটনি ইত্যাদি। তিনি আরও বলেন, দশমীর দিন শান্তির জল দেওয়া হয় এবং সেখানে উপস্থিত থাকেন এলাকার মানুষেরাও। বাড়িতে মায়ের সকালবেলায় বিসর্জন হয়। কারণ যতক্ষণ না দেবী বিসর্জিত হন ততক্ষণ বড়ো গোস্বামী বাড়ির ইষ্টদেবতা শ্রীরাধারমণের ভোগ রান্নার কাজ শুরুই হয় না। তাই  মা শ্বশুরবাড়িতে রওনার পরেই ভোগ রান্না শুরু হয়।

Article by: শুভদীপ রায় চৌধুরী

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)