মহালয়ার ভোরে বাঙালি চাননি উত্তমকুমারকে, চেয়েছিলেন চিরকালের বীরেন্দ্রকৃষ্ণের 'মহিষাসুরমর্দিনী'
কলকাতা:
বাঙালির নস্টালজিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন, দুর্গাপুজো এলেই তাঁর কণ্ঠ
শুনতে চান আট থেকে
আশি সকলেই, তিনি কিংবদন্তি শিল্পী
বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র। বলাবাহুল্য, তাঁর
কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ না শুনলে বাঙালির
দুর্গাপুজোই শুরু হয়না, ঠিক
তেমনই বঙ্গদেশে দুর্গার
প্রায় অসম্পূর্ণই থেকে যেত। তবে
শুধুমাত্র বাচিক শিল্পী হিসাবেই নয়, বেতার সম্প্রচারক,
গায়ক, নাট্যকার, অভিনেতা এবং সর্বোপরি নাট্য
পরিচালক হিসাবে তাঁর কৃতিত্ব অপরিসীম।
মহালয়ার ভোরে রেডিওতে মহিষাসুরমর্দিনী- গীতি আলেখ্য এবং
সেখানে সেই কণ্ঠ- যা
অমরত্ব লাভ করেছে।
১৯০৫ সালে আজকের
দিনে উত্তর কলকাতার আহিরীটোলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি৷ বাবা
রায় বাহাদুর কালীকৃষ্ণ ভদ্র, ছিলেন বিখ্যাতা ভাষাতত্ত্ববিদ, যিনি ১৪ টি
ভাষায় সাবলীল ভাবে কথা বলতে
পারতেন। নিম্ন আদালতে দোভাষী হিসাবে কর্মরত ছিলেন এবং পরবর্তীকালে তৎকালীন
বাঙালি সাহিত্য মহলে পরিচিতি লাভ
করেছিলেন।
উল্লেখ্য, বীরেন ভদ্রের ঠাকুরমা যোগমায়া দেবীর কাছেই ছোটোবেলায় সংস্কৃত শিক্ষা পান৷ ঠাকুমা-ই
শেক্সপিয়ার আর গিরিশচন্দ্রের নাটক
পড়ে পড়ে শোনাতেন ছোট্ট
বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে। তবে অংকে একেবারেই
মন ছিল না বীরেনের।
ম্যাট্রিক পাশ করেই জ্যামিতি,
বীজগণিতের যত বই সব
গঙ্গায় দিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু
ছোটবেলা থেকেই তাঁর স্মৃতিশক্তি
প্রখর, ভাল আবৃত্তি করতে
পারতেন। একসময়ে তাঁর প্রাথমিকের শিক্ষক
রাজেন্দ্রনাথ দে এক আবৃত্তি
প্রতিযোগিতায় বীরেনের নাম লিখিয়ে দেন।
‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ ছিল আবৃত্তির বিষয়।
মাঝে মাঝেই তাগাদা দিতেন, মুখস্থ কত দূর হয়েছে
জানার জন্য। তবে সেই প্রতিযোগিতায়
প্রথম স্থান পান বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। তারপর
স্কটিশচার্চ কলেজে ভর্তি হন বীরেন, সেখানে
পড়াশোনার পাশাপাশি সংস্কৃতিচর্চাও চলতে থাকে তাঁর।
একের পর এক অনুষ্ঠানে
তাঁর অংশগ্রহণ যা আজ এক
ইতিহাস। ১৯২৮ সালে স্কটিশচার্চ
কলেজ থেকে বি.এ
পাস করেন। তবে তার মধ্যেই
চলে কম্বুলিয়াটোলায় ‘চিত্রা সংসদ’ ও সাহিত্যিসাধক নলিনীরঞ্জন
পণ্ডিত প্রতিষ্ঠিত ‘অর্ধেন্দু নাট্য পাঠাগার’-এ গানবাজনা এবং
অভিনয় চর্চা। ১৯২৮-এ ইস্ট
ইন্ডিয়া রেলওয়ের সদর দপ্তরে যোগ
দেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ, তবে মন পড়ে
থাকত সেই বেতার কেন্দ্রে।
প্রথমবার বীরেন ভদ্রের পরিচালনায়
নাটকে অভিনয় করলেন বাণীকুমার, পঙ্কজ মল্লিক এবং পশুপতি চট্টোপাধ্যায়।
১৯২৮-এর ২৬ অগস্ট
বেতারে সম্প্রচার হল ‘চিকিৎসা সংকট’। সেসময় ডিরেক্টর নৃপেন মজুমদারের ডাকেই ১৯২৮-এ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ
রেডিয়োয় সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দেন।
১৯৩১-এর ৮
মে বেতারে অভিনীত হল ডি এল
রায়ের নাটক ‘সাজাহান’। সেখানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ
অভিনয় করলেন ঔরঙ্গজেবের চরিত্রে।
এর পাশাপাশি,অহীন্দ্র চৌধুরী (সাজাহান), দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (দারা), নিভাননী (জাহানারা) এবং মিস বীণাপাণি
(পিয়ারী)। এছাড়া, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দীনবন্ধু মিত্র,
মাইকেল মধুসূদন, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ প্রমুখ দিকপাল নাট্যকারদের বহু নাটক বীরেন্দ্রকৃষ্ণর
প্রযোজনায় বেতারস্থ হয়েছে।
তবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের সর্বকালীন
সেরা সৃষ্টি- মহালয়ার
ভোরে- ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। আকাশবাণী কলকাতার সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান বলা যায়। বছরের
পর বছর ধরে বাঙালির
আবেগ এই মহিষাসুরমর্দিনী। অনুষ্ঠানের
সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক, বাণীকুমার, এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
তবে এই অনুষ্ঠান যত
জনপ্রিয় হতে থাক ততই
এটিকে ঘিরে তৈরি হয়
নয়া বিতর্ক। আর বিতর্কের গড়ে
তোলেন তখনকার দিনের গোঁড়া ব্রাহ্মণসমাজ। তাঁরা বলেছিলেন যে, মহালয়ার ভোরে
অব্রাহ্মণের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ শোনার কোনও যৌক্তিকতা নেই।
সেই প্রতিবাদের পর এই অনুষ্ঠানকে
সরিয়ে ষষ্ঠীর ভোরে নিয়ে যাওয়া
হয়। কিন্তু শ্রোতাদের চাপে ১৯৩৬ সাল
থেকে পুনরায় অনুষ্ঠানটিকে মহালয়াতেই বাজানো শুরু হয়। অর্থাৎ
ধর্মীয় গোঁড়ামিকে ভেঙে দিয়ে বাঙালি
শুনতে চেয়েছিলেন বীরেন ভদ্রের সেই কালজয়ী কণ্ঠ।
উল্লেখ্য, অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেক শিল্পীর নিষ্ঠা ছিল দেখবার মতো।
লাইভ সম্প্রচারের সময় কলাকুশলীরা ভোররাতে
স্নান সেরে শুদ্ধ আচারে
উপস্থিত হতেন। আর বীরেন ভদ্র
পরতেন গরদের জোড়, কপালে চন্দনের
ফোঁটা।
প্রভাতী অনুষ্ঠানটির জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে ঠিক
সেইসময় (১৯৭৬ সালে) আকাশবানী
কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেন এই অনুষ্ঠান
বাতিল করে অন্য অনুষ্ঠান
বাজানো হবে মহালয়ায়। অনুষ্ঠানটির
নাম- ‘দেবীদুর্গতিহারিণীম্’, লিখেছিলেন ধ্যানেশনারায়ণ চক্রবর্তী। সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গান লিখেছিলেন শ্যামল
গুপ্ত। আর ভাষ্যপাঠে
উত্তমকুমার। তবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের স্থানে
মহানায়ককে একেবারেই গ্রহণ করেননি দর্শকেরা। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’কে বাদ দেওয়ার জন্য
ক্ষোভে ফেটে পড়ে সাধারণ
মানুষ। তৎকালীন আকাশবাণীর জনপ্রিয় উপস্থাপক মিহির বন্দ্যোপাধ্যায় এক জায়গায় লিখেছেন,
‘দেবীদুর্গতিহারিণীম্’ অনুষ্ঠানটি
সম্প্রচারের মধ্যপথেই টেলিফোনে শ্রোতাদের অবর্ণনীয় গালিগালাজ আসতে শুরু করে
অকথ্য ভাষায়। অনুষ্ঠান শেষ হতে না
হতেই আকাশবাণী ভবনের সামনে সমবেত হয় বিশাল জনতা।"
তখন বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষকে চালাতে
হয় সেই চিরকালের 'মহিষাসুরমর্দিনী'। অর্থাৎ, বাঙালির
আবেগের
সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
যদি সেদিন উত্তমকুমার কিন্তু এ দায়িত্ব নিতে চাননি। তিনি বীরেন ভদ্রের কাছে গিয়ে তাঁর অস্বস্তি এবং অযোগ্যতার কথাও জানিয়েছিলেন। আর বীরেন ভদ্র অবশ্য তাঁকে আশ্বস্ত করে উৎসাহ দিয়েছিলেন। আর সম্প্রচারের দিন খাটে বসে ছেলের সঙ্গে মন দিয়ে শুনেছিলেন উত্তমকুমারের মহালয়া। সবটা শোনার পরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বলেছিলেন, “লোকে যদি নেয় নিক।” দেশ বিদেশে মহিষাসুরমর্দিনী নিয়ে এত উচ্ছ্বাস, কিন্তু বীরেন ভদ্র এ সবে বিন্দুমাত্র সাড়া দিতেন না। বলতেন, “বেশ মজা আর কি, পুরাণ পড়ব না, চণ্ডীপাঠ করব না, শুধু বৈঠকখানায় বসে স্টিরিয়োতে মহিষাসুরমর্দিনী শুনেই কর্তব্যকার্য শেষ! কাজীদা (নজরুল) হলে কী বলতেন জানো? বলতেন, দে গরুর গা ধুইয়ে, যত্তোসব!” তবে সেদিন বাঙালিদের তাঁর প্রতি আবেগ দেখে আবারও বেতারে কাজ করতে শুরু করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
Article by: শুভদীপ রায় চৌধুরী