মহাষ্টমীর দিন গান ফায়ার করা হয় জোড়াসাঁকো নরসিংহ দাঁ বাড়িতে

0

মহাষ্টমীর দিন গান ফায়ার করা হয় জোড়াসাঁকো নরসিংহ দাঁ বাড়িতে

কলকাতা: উত্তর কলকাতার বনেদি বাড়িগুলির অন্যতম জোড়াসাঁকোর নরসিংহ দাঁ বাড়ি। এই বাড়ির প্রভাব প্রতিপত্তি এতটাই বেশি যা নজর কাড়ে দর্শনার্থীদের। কারণ এ বাড়ির সঙ্গে বন্দুকের সম্পর্ক বহু প্রাচীন। বলাবাহুল্য, বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা নরসিংহ চন্দ্র দাঁই প্রথম বাঙালি এবং ভারতীয় বন্দুক ব্যবসায়ী। তাই তাঁর বাড়ির দুর্গাপুজোয় বন্দুকের ছোঁয়া থাকবে না তা কী হয়?

সিপাহী বিদ্রোহের সময় বন্দুকের এক চেটিয়া ব্যবসায় ব্রিটিশ বন্দুক কোম্পানিদেরও টেক্কা দেন এই বাঙালি ব্যবসায়ী। ১৮৫৯ সালে নরসিংহ দাঁয়ের উদ্যোগেই তাঁর বাড়িতে শুরু হল দুর্গাপুজো। দাঁ বাড়িতে তিনি দশভুজা নয় বরং পূজিত হন বাড়ির মেয়ে হিসাবেই।


রথের দিন একটি গরান কাঠ পুজোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি। প্রতিমা তৈরির সময় এই কাঠ প্রতিমার দেহের মধ্যে দিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিপদের দিন দেবীর বোধন হয় এবং সপ্তমীর দিন নবপত্রিকা স্নান করিয়ে আসার পর কুলদেবী লক্ষ্মীকে ঠাকুরঘর থেকে ঠাকুরদালানে নিয়ে আসা হয়। সেকালে নবপত্রিকা স্নানের সময় বন্দুক এবং তলোয়ারধারী প্রহরী যেত নবপত্রিকার সঙ্গে, তবে সে প্রথা এখন আর পালন হয় না।

উল্লেখ্য, লক্ষ্মীনারায়ণ পুজোর মধ্য দিয়েই সপ্তমীর পুজো শুরু হয়। সাবেকি একচালার ডাকের সাজের প্রতিমায় পরানো হয় সোনার গয়না। দেবীর গাত্রবর্ণ স্বর্ণবর্ণা, অসুরের রঙ সবুজ এবং গণেশ গোলাপি রঙের হয়। দাঁ বাড়িতে দেবীকে অন্নভোগ দেওয়া হয় না। তার পরিবর্তে লুচি ভোগ হয়। পঞ্চমীর দিন বাড়িতে ভিয়েন বসে। সে দিন থেকেই নানান রকম মিষ্টি তৈরি হওয়া শুরু হয়। এ বাড়ির ভোগে পাঁচ রকম মিষ্টি, নোনতা এবং দই। এছাড়াও দেওয়া হয় পান্তুয়া, গজা, মিহিদানা।


উল্লেখ্য, দুর্গাপুজো শুরুর দিন থেকেই এই বাড়ির মহাষ্টমীপুজোর রীতি একেবারেই স্বাতন্ত্র। সন্ধিপুজোয় এক মণ চালের নৈবেদ্য হয়, যেটি শুধুমাত্র বাড়ির ছেলেরাই সাজিয়ে থাকেন। সম্পূর্ণ বৈষ্ণবমতে পুজো হয় বলে পুজোর ভোগে ফল, নানান মিষ্টি ও লুচি দেওয়া হয়। তাই কোন রকম বলিও হয় না। বাড়ির প্রাচীন রীতি অনুযায়ী আজও সন্ধিপুজোয় গর্জে ওঠে কামান। ১০বোরের এই ছোট্ট কামানটি সেকালে তৈরি করেছিল আমেরিকার ‘উইনচেষ্টার রিপিটিং আর্মস’ কোম্পানি। তাছাড়া বন্দুক স্যালুটও দেওয়া হয়। নরসিংহ দাঁ পরিবারের সদস্যরা মনে করেন, এই সন্ধিক্ষণে দেবী আসেন তাঁদের বাড়িতে। তাই উমাকে স্বাগত জানাতে ‘জয় মা’ ধ্বনি দেন তাঁরা। দেবী যাতে অবাধে বাড়িতে আসতে পারেন সেই জন্য এই সময়ে বাড়ির সমস্ত দরজা জানলা খুলে দেওয়া হয়। মহাষ্টমীর আরতি চলাকালীনও বেশ কয়েক বার শূন্যে গুলি চালানো হয়। প্রাচীন প্রথা মেনেই মহানবমীর দিন কুমারী পুজো হয় এই বাড়িতে। এরপর যজ্ঞ এবং পুজোর সমস্ত আচার অনুষ্ঠান শেষে নবমীর দিন রাতে মাছ খান বাড়ির সদস্যরা।

দশমীর দিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘটে ঠাকুর বিসর্জনের পর ব্যবসার সূত্রে ‘যাত্রা’ করেন বাড়ির সদস্যরা। ‘যাত্রা’ অর্থাৎ ঠাকুর বাড়িতে থাকাকালীন পুজোর ফুল বিল্বপত্র দোকানে গিয়ে সামান্য কিছু বিক্রিবাটা করা যাতে সারা বছর দেবীর কৃপায় ব্যবসায় লাভ হয়। দশমীর দিন দেবী বরণের পর এই বাড়ির পুরুষেরা মহিলাদের কনকাঞ্জলি দেন। পুজো শেষে বাড়ির মহিলারা আঁচল পেতে দাঁড়ান। বাড়ির পুরুষেরা পিছন দিকে চাল, কড়ি, পান এবং সুপুরি ছুড়ে দেন। মহিলারা কনকাঞ্জলি গ্রহণ করে ঠাকুরঘরে নিয়ে গিয়ে সেই জিনিস এক বছর যত্ন করে রাখেন। প্রতিমা বিসর্জনের জন্য যখন দেবীকে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসা হয় সেই সময় তাঁকে সম্মান জানাতে গান স্যালুট দেন বাড়ির সদস্যরা। আগে ওড়িশা থেকে আসা বাহকেরা কাঁধে করে ঠাকুর নিয়ে যেতেন। ঠাকুরের সঙ্গে দু’দিকে তিন জন করে মশাল বাহক থাকতেন। সেই সঙ্গে থাকতেন সশস্ত্র রক্ষীরা। ঘাটে প্রস্তুত থাকত নৌকো। তখন নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে সেই নৌকো নিয়ে মাঝগঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হত দেবীকে। এখনও কাঁধে করেই প্রতিমা বিসর্জন করা হয় জোড়াসাঁকো নরসিংহ দাঁ বাড়িতে।

Article by: শুভদীপ রায় চৌধুরী

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)