মহানবমীর দিন কালো প্রদীপের আরতি হয় আন্দুল দত্তচৌধুরী বাড়িতে
হাওড়া:
হাওড়ার সুপ্রাচীন বনেদি বাড়ির খোঁজ করলে যাদের
নাম সর্বপ্রথম উঠে আসে, তাঁরা
হলেন আন্দুলের চৌধুরী পাড়ার দত্তচৌধুরীরা। তাঁদের বাড়ির ঠাকুরদালানে পৌঁছালেই ঐতিহ্য এবং সাবেকিয়ানা যেন
জ্বলজ্বল করে ওঠে। তবে
এই বংশের শিকড় গ আরও গভীরে।
দশম শতাব্দীতে কান্যকুব্জ থেকে বাংলায় পাঁচ
বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ বংশের পাশাপাশি এসেছিলেন পাঁচ ক্ষত্রিয়ও। সেই
পাঁচ ক্ষত্রিয়ের অন্যতম এই দত্তচৌধুরীরা। তাঁদের
বংশের পুরষোত্তম দত্ত বঙ্গের বীরভূমের
মল্লারপুর গ্রামে থাকতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে
তাঁর অধস্তন দিবাকর দত্ত বালি গ্রামে
এসে থাকতে শুরু করেন এবং
তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের তেকড়ি দত্ত বালি থেকে
উঠে চলে যান এক
জনপদে, পরবর্তীকালে তারই নামকরণ হয়
আন্দুল।
বাংলায় সুলতানি আমলে এই পরিবারের
সুসন্তান প্রতিপত্তিশালী দেবদাস দত্তকে ‘জমিদার’ ঘোষণা করা হয় এবং
নতুন উপাধি দেওয়া হয় ‘চৌধুরী’। বংশের নতুন
পরিচয় হয় ‘আন্দুলের দত্তচৌধুরী’। বলাবাহুল্য, মুরারি
দত্তবিশ্বাসের কনিষ্ঠ সন্তান দেবদাস ওরফে তেকড়ি দত্ত
পূর্বপুরুষের সম্পদ নিয়ে চতুর্দ্দশ শতকের শেষ ভাগে বজরা
যোগে তৎকালীন মুজঃফরপুর পরগনায় এসে সরস্বতী নদীর
পশ্চিম তীরে ২৫২ বিঘা
ভদ্রাসন জমির উপর প্রাসাদ নির্মাণ করেন সেখানেই এবং
দেবালয় স্থাপন করে বাস করতে
থাকেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন ব্রাহ্মণ,
ধোপা, নাপিত, কুমোর, কামার, মালাকার, দুলে, ধীবর, শবর ইত্যাদি পরিবারকে।
জঙ্গল পরিষ্কার করে ছোট-ছোট
কাঁচা পথ নির্মাণ করেন,
এই ভাবে তিনি সেই
জনপদের জনক হয়েছিলেন। সেই
দেখেই তৎকালীন বাংলার সুলতান তাঁকে ‘চৌধুরী’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এই ভাবে তিনি
জমিদারির পত্তন করেছিলেন সেই জনপদে। বর্তমান
স্থানীয়রা অনেকেই তাঁদের ‘আন্দুলের
চৌধুরী’ বলেই
চেনেন। এছাড়া, এই ভরদ্বাজ গোত্রীয়
জমিদার বংশের সুসন্তান নারায়ণ দত্ত রাজা লক্ষণ
সেনের রাজসভাতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীও ছিলেন।
উল্লেখ্য, এই পরিবারে প্রথম
দুর্গাপুজো শুরু করেন রামশরণ
দত্তচৌধুরী। তবে ঠিক কোন
সালে তিনি দুর্গাপুজো শুরু
করেছিলেন, তার লিখিত নথি
নেই। তবে পরিবার সূত্রে
খবর, বংশের পূর্বপুরুষ কৃষ্ণানন্দের কনিষ্ঠপুত্র কন্দর্পেরামের জ্যেষ্ঠ সন্তান জমিদার রামশরণ দত্তচৌধুরী (১৫৪৮-১৬০৬ খ্রিঃ)
এই পরিবারে প্রথম দুর্গাপুজো শুরু করেন ১৫৬৮
খ্রিস্টাব্দে।
সেদিক
দিয়ে দেখতে গেলে আন্দুলের এই দত্তচৌধুরীদের
পুজো বাংলার প্রাচীন পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম।
চারশো বছরেরও প্রাচীন এই পুজোয় আজও
প্রাচীন রীতিনীতি মেনে চলা হয়।
মহিষাসুরমর্দিনী দশভুজা হলেও তিনি বরাবরই
চৌধুরীদের ঘরের মেয়ে উমা।
বনেদি পরিবারে সাবেকি প্রতিমায় টানাচৌরি আকৃতির চালচিত্র হয়। তাতে দুর্গার
ডানদিকে চালিতে আঁকা থাকে দেবী
জগদ্ধাত্রীর চিত্র, মাঝে শ্রীঅনন্ত-বিষ্ণুর
চিত্র এবং ডানদিকে চালিতে
দক্ষিণাকালীর চিত্র। লক্ষ্মীর চালির উপরে রাখা হয়
জয়ার মূর্তি, দুর্গার চালির উপরে রাখা হয়
মহাদেবের মূর্তি এবং সরস্বতীর চালির
উপরে রাখা হয় বিজয়ার
মূর্তি। আগে বিগ্রহে মাটির
শাড়ি ও অলংকার থাকতো।
এ বাড়ির পুজো হয় বৃহন্নন্দিকেশ্বর
পুরাণ মতে। কাঠামো পুজো
হয় জন্মাষ্ঠমীর দিন এবং বোধন
বসে কৃষ্ণনবমী তিথিতে। পরিবারের অবিবাহিতা মেয়েদের দেবীপক্ষ পরলে হাতে শাঁখা
পরতে হয়, তবে নোয়া
পরতে পারবে না, এমনই রীতি।
ষষ্ঠীর দিন তাঁকে সবুজ
ওড়না পরিয়ে দেন বাড়ির মহিলারা।
আর দশমীতে ওড়না পাল্টানো হয়। এই রীতি
পালিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন
ধরে। সন্ধিপুজোয় কামানের শব্দ কিংবা দশমীতে
নীলকণ্ঠ পাখি, কোনওটাই আর ভাসে না।
কিন্তু সেকালের নিয়ম
মেনে আজও চৌধুরীরা পুজোর
ভোগে দেন পুরীর জিবেগজা।
বলা যায়, জিবেগজা আর
খাজা ছাড়া এই বাড়ির পুজোর
ভোগ অসম্পূর্ণ। এছাড়া, নারকেল নাড়ু, চন্দ্রপুলি, ক্ষীরের ছাঁচ, মনোহরা-সহ নানান মিষ্টান্ন
থাকে।
প্রসঙ্গত, দেবীর নৈবেদ্যর মাথার উপরে দেওয়া হয়
আগমণ্ডা। এই মিষ্টির ভিতরে
থাকে মেওয়া, নারকেলবাটা আর ক্ষীরের পুর।
এর পাশাপাশি,
পুজোর প্রতিদিনই নিবেদন করা হয় অন্নভোগ।
ভোগে থাকে খিচুড়ি বা
পোলাও, ভাজা, তরকারি, পায়েস ইত্যাদি। অতীতে চৌধুরীদের বাড়ির দুর্গাপুজোয় বলি হত। কিন্তু
পরবর্তীকালে পশুবলি বন্ধ হয়। তার
জায়গায় মহানবমীর দিন আঁখবলি, চালকুমড়ো
বলি এবং চালের পিটুলি
দিয়ে মানুষ তৈরী করে হয়
‘শত্রু ববলি’। এছাড়া পুজোর
ভোগ যখন সদস্যদের পরিবেশন
করা হয়, তখন সকলে
মুখে একবার হলেও বলেন, ‘রামশরণের
কড়াই ধর’-
এ এক অদ্ভুত রীতি
চলে আসছে পরিবারে। এছাড়া,
পরিবার থেকে অশুভ কালো
ছায়াকে দূরে করতে আরও
একটি রীতি পালিত হয়ে
আসছে বহু শতক ধরে।
মহানবমীর সকালে প্রতিমার সামনে কালো প্রদীপের আরতি
করেন পুরোহিত। মোট ২৮টি প্রদীপ
নিয়ে আরতির পরে তা উল্টে
রেখে নিভিয়ে ফেলা হয়- একেই
বলা হয় কালি প্রদীপের
আরতি। এছাড়া, নবমীর দিন হয় কুমারী
পুজো এবং ধুনো পোড়ানো।
দশমীর দিন সন্ধ্যেয় দেবী
বরণের পর কনকাঞ্জলি
প্রথা পালিত হয়। এরপর আন্দুলের
পাশের ঝোড়হাট গ্রামের রাজবংশী সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁদের কাঁধে করে প্রতিমা নিয়ে
যায় আন্দুলের দুলেপাড়ায়। এই শোভাযাত্রায় চৌধুরীদের
কোনো মহিলাদের অংশগ্রহণ করার নিয়ম নেই।
এরপর ওই দুলেপাড়াতে দুলে
উপজাতির মেয়েরা দেবীকে বরণ করার পর
পুনরায় শোভাযাত্রা করে চৌধুরী পাড়ায়
নিয়ে এসে দালানের কাছের
পুকুরেই প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয়।
Article by: শুভদীপ রায় চৌধুরী