গুরুপূর্ণিমার মাহাত্ম্য

0

গুরুপূর্ণিমার মাহাত্ম্য

শুভদীপ রায় চৌধুরী (আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক)

গুরুপূর্ণিমা, সনাতন ভারতবর্ষে এই তিথির মাহাত্ম্য অনস্বীকার্য। সনাতন ধর্ম বা যে কোন শাস্ত্র যা ভগবানের শ্বাস থেকে সৃষ্ট, যা কোন প্রবর্তক বা কোন মনুষ্যের সৃষ্ট নয়, যার ব্যাপ্তি অসীম, জীব যেদিন সৃষ্ট হয়েছে সেদিন থেকেই সনাতন ধর্মের উৎপত্তি। আর গুরুপূর্ণিমার মাহাত্ম্য সমস্ত শিষ্যদের কাছে অনেক বেশি। কারণ এদিন তাঁরা নিজ নিজ গুরুকে পূজা করেন এবং শ্রীগুরুর পাদপদ্মে নিজেকে অর্পণ করেন। সনাতন ধর্মে জীবের শিক্ষাদানে য়াঁর অবদান চিরস্মরণীয়, তিনি হলেন ভগবান বেদব্যাস। দ্বাপরযুগের শেষ দিকে পরাশর মুনি ও মৎস্যগন্ধা সত্যবতীর পুত্র রূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ঋষি ব্যাসদেব। শাস্ত্রী তাঁকে ভগবানের চব্বিশ অবতারের এক অবতাররূপেই বর্ণনা করা আছে। বলাবাহুল্য, ভগবান বেদব্যাসের আবির্ভাব হয় আষাঢ়ী পূর্ণিমাতিথিতে এবং সনাতনধর্মে গুরুরূপে তাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি যা অন্যত্র আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই বেদব্যাসের জন্মতিথিকেই গুরুপূর্ণিমা বলে উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ কলিযুগে যিনি আদিগুরু রূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাই তাঁকেই ভগবানের প্রেরিত অবতারস্বরূপ হিসাবেই উল্লেখ করা হয়। কারণ, জীব কিভাবে সেই অনন্ত আনন্দের সন্ধান পাবে বা পারমার্থিক শান্তিলাভ করবে সেই পথ সন্ধানে সবচেয়ে বেশি ব্যাকুল ছিলেন গুরু বেদব্যাস।

এই বেদব্যাসই আবার বেদকে চারভাগে বিভক্ত করেন। যথাক্রমে- ঋক্‌, সাম, যজুর্বেদ ও অথর্ববদে। কথিত আছে যে, বেদ'কে এই চারভাগে বিভক্ত করেন বলেই তিনি বেদব্যাস নামে খ্যাত হন। ষড়দর্শনের মধ্যে বেদান্তদর্শন সেটিও তাঁর রচনা, যাকে আবার ব্রহ্মসূত্র বলেও উল্লেখ করা হয়। এর পাশাপাশি, কলিযুগে জীবের পক্ষে বেদের সঠিক অর্থ অনুধাবন করা অসম্ভব জেনেই রচনা করে ফেললেন মহাকাব্য 'পঞ্চম বেদ স্বরূপ'। এছাড়া, বেদকে সঠিক মর্যাদা দিতে অথবা বেদের পরিপূরক হিসাবে এবং সর্বোপরি সাত্ত্বিক, রাজসিক, তামসিক প্রভৃতি সমস্ত জীব যেন ব্রহ্মের সঠিক পথ খুঁজে পায় তাই রচনা করলেন 'পুরাণ'। এই পুরাণ মোট ১৮টি, তার মধ্যে ছয়টি সাত্ত্বিক, ছয়টি রাজসিক এবং ছয়টি তামসিক পুরাণও রচনা করলেন ভগবান বেদব্যাস।

এই আঠেরোটি পুরাণ রচনার পর গুরু বেদব্যাসের শেষ কীর্তি হল শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণ। সুতরাং ভগবান বেদব্যাস জীবকে পারমার্থিক শান্তি দেওয়ার জন্য সমস্ত রকমের প্রচেষ্টা করেছেন এবং সনাতনধর্মে যত মতবাদ রয়েছে এমন প্রতিটি পরম্পরাতেই বেদব্যাস গুরুরূপে অধিষ্ঠান করছেন। সুতরাং সেই বেদব্যাস যে পরম্পরায় মাধ্যমে যে শরীরকে আশ্রয় করে দিব্যজ্ঞানকে আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, সেই পারমার্থিক শান্তির পথ বলে দিচ্ছেন সেই শ্রীগুরুকে গুরুপূর্ণিমার দিন পূজা করাই জীবের একমাত্র কর্তব্য। এমনকি, মহাপুরুষেরা যে আসনে অধিষ্ঠান করেন সেই আসনকেও 'ব্যাসপীঠ' বলে উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ, ভগবান বেদব্যাসই তাঁর সমস্ত কার্য পরম্পরাগত ভাবে গুরুর দিয়ে গিয়েছেন যা পেয়ে আমরা ধন্য। আর সেই ব্যাসপীঠে বসে যিনি জীবের মধ্যে আধ্যাত্মিক ধর্ম এমনকি দিব্যচেতনার বাণী বিতরণ করে আমাদের এই মায়াময় জগতের মোহ থেকে মুক্ত করে দিব্য তথা অনন্ত প্রেমের পথে নিয়ে চলেন তিনিই আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ বেদব্যাস (নিজ নিজ গুরুদেব)।

তাই গুরুকেই ভগবান বেদব্যাসের প্রতিনিধিরূপে গুরুপূর্ণিমার দিন পূজা করা হয়। তাই এদিন সম্পূর্ণ গুরু পরম্পরাকে পূজা করাই শিষ্যের একমাত্র কাজ হওয়া উচিত। সেদিন গুরুস্বরূপকেই ভগবান স্বরূপে আরাধনা করাই উচিত। শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে, গুরুপূজায় চারটি উপাদান অবশ্যই প্রতিটি শিষ্যকে দিতে হয়, তবেই গুরুপূজা সার্থক। সেই চারটি উপাদান হল- আসন, বসন, ভূষণ এবং বাহন। তাই গুরু পূজার উপযুক্ত আসন হল- হৃদয়াসন। অর্থাৎ হৃদয় রূপী আসন দিতে হবে শ্রীগুরুকে। আর গুরুর প্রতি অনুরাগের বসন প্রদান করতে হবে শিষ্যকে। সবসময় যেন গুরুর প্রতি অনুকূলে চলতে পারি, প্রতিকূল যেন না হয় এবং তাঁর প্রতি সেবার উৎকণ্ঠা- এই নিরন্তর অনুরাগের বসনই গুরু পূজার উপযুক্ত। এর পাশাপাশি, নিরন্তর ভগবানের শ্রীনামের ভূষণ দিতে হবে ও গুরুর আজ্ঞা যেন বহন করে চলা যায়, গুরু আজ্ঞা যেন প্রতিমুহূর্তে এবং প্রতি কাজে জীব পালন করতে পারে সেই বাহনই গুরু পূজার উপযুক্ত উপাচার।

তাই সদগুরুর পূজার উপাচার হওয়া উচিত পারমার্থিক উপচার, কারণ গুরুর সঙ্গে শিষ্যের সম্পর্ক জন্মজন্মান্তরের, ঈশ্বর চেয়েছেন তাই সঠিক সময়ে মিলিয়ে দিয়েছেন। তাই কোন জাগতিক সম্পর্ক নয় তাঁর সঙ্গে, সবটাই পূর্ব নির্ধারিত এবং দিব্যজ্ঞান সংগ্রহের সন্ধানে। তাই সমস্ত পরনিন্দা পরচর্চা ছেড়ে এবং মায়ায় জড়িয়ে না পড়ে পারমার্থিক শান্তিলাভের চেষ্টায় গুরুর সান্নিধ্যে এলেই তবেই ভগবানের সঠিক পূজা সম্ভব এবং গুরুপূজাও সম্ভব।

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)