১০৮টি অপরাজিতা ফুলেই সন্ধিপুজো সম্পন্ন হয় দর্জিপাড়া মিত্রবাড়িতে

0

১০৮টি অপরাজিতা ফুলেই সন্ধিপুজো সম্পন্ন হয় দর্জিপাড়া মিত্রবাড়িতে?

কলকাতা: বনেদি কলকাতা বললেই মথায় আসে উত্তর কলকাতার প্রাচীন বাড়িগুলির কথা। এদের শুধু বয়সই বাড়েকিন্তু ঠাকুরদালানের সেই ঐতিহ্য আর পাঁচ খিলানের সৌন্দর্য্য যেন কিছুতেই পুরানো হয় না, যখনই চোখ যায় তখনই নতুন লাগে। শারদোৎসবে থিমের আড়ম্বরতা থাকলেও বনেদি পুজোর রীতিনীতি দেখতে ভিড় করেন পুজোপ্রেমীরা। সারাবছর অপেক্ষার পর ঘরের মেয়ের ঘরে আসার আনন্দে বনেদি বাড়িগুলি আবারও নতুন করে সেজে ওঠে৷

 উত্তর কলকাতার নীলমণি মিত্র স্ট্রিটের মিত্রবাড়ি, এখন এ বাড়িতে ধুমধাম করে শারদীয়া দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। বাড়ির মেয়েরাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন আর দেবী আরাধনার প্রধান দায়িত্বে থাকেন বাড়ির বড় মেয়ে অনুসূয়া বিশ্বাস মিত্র। রথের দিন কাঠামো পুজোর পরই ধীরে ধীরে ঠাকুরদালানেই গড়ে ওঠে উমা। পুজোর সময়  দেবী প্রতিমার গায়ে ঝাড়বাতির আলো- যেন ঠিকরে পড়ে তাঁর ত্রিনয়নের দিকে৷ সেই প্রাচীন রীতি মেনে আজও পুজো করে আসছেন মিত্র বাড়ির বর্তমান প্রজন্মের সদস্যরা।

   প্রসঙ্গত, উত্তর কলকাতার বিখ্যাত রাস্তা নীলমণি মিত্র স্ট্রিট, আর সেই রাস্তায় মিত্র বাড়ির দুর্গাপুজো- একডাকেই সকলে চেনে। নীলমণি মিত্রের ছেলে রাধাকৃষ্ণ মিত্র এই বাড়ির পুজো শুরু করেন। সেকালে আড়িয়াদহ থেকে  সুতানুটি অঞ্চলে আসেন পরিবারের সদস্য জগন্নাথপ্রসাদ মিত্র। রাঢীয় কুলীন কায়স্থ সম্প্রদায়ভুক্ত এই মিত্র বংশের প্রতিষ্ঠাতা তিনিই। তবে জগন্নাথ প্রসাদের পৌত্র দুর্গাচরণ ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার ‘কোর্ট জুয়েলার। এছাড়াও তাঁর নানান ব্যবসা ও নুনের দেওয়ানি ছিল। সেই কাজের দপ্তরে একসময়ে কাজ করতে এসেছিলেন সাধক-কবি রামপ্রসাদ সেন। হিসেবের খাতায় তাঁর লেখা গান পড়ে খুশি হয়ে হয়ে দুর্গাচরণ মিত্র সাধক রামপ্রসাদের আজীবন মাসোহারার ব্যবস্থা করে দেন।

    বলাবাহুল্য, এই দুর্গাচরণ মিত্রের ভ্রাতুষ্পুত্র নীলমণি মিত্র ছিলেন সে সময়ের গণ্যমান্য ব্যক্তি। নীলমণি মিত্রর পৌত্র রাধাকৃষ্ণ মিত্র  ১৮০৬-এ দর্জিপাড়া মিত্রবাড়িতে দুর্গোৎসবের সূচনা করেন। এখন রাধাকৃষ্ণের মেজো ছেলে রাজকৃষ্ণ মিত্রের বংশধরেরা এই পুজো করে আসছেন। এবার ২১৮ বছরে পড়ল এই বাড়ির দুর্গাপুজো। তবে এই ঠাকুদালানেই পুজো হয়ে আসছে এত বছর ধরে ৷

   রাধাকৃষ্ণ মিত্রের পঞ্চম বংশধরের কোনও  পুত্র সন্তান না থাকায় এখন বাড়ির মেয়েরাই পুজোর সমস্ত দায়িত্ব পালন করেন। এই বাড়িতে দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতীর দেবীমুখ এবং কার্তিক ও অসুরের মুখ বাংলা ধাঁচের হয়। প্রাচীন সেই মুখের ছাঁচ আজও সংরক্ষণ করে রাখা আছে ৷ তিনচালির মঠচৌড়ি আকৃতির  প্রতিমা নির্মাণ করা হয়। তার উপর মাটির নকশা করা তিনটি মঠের চূড়ার আকৃতির চালি। দুর্গা, লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে পরানো হয় ডাকের সাজ। আর কোঁচানো ধুতি পরেন কার্তিক এবং গণেশ। এ বাড়ির সিংহ  ঘোড়ামুখো। সবচেয়ে বিশেষত্ব হল- এ পুজোর যাবতীয় সাজ কিন্তু পরিবারের সদস্যদের হাতেই তৈরি। তারাই সাজিয়ে তোলেন দশভুজাকে।

    মিত্র বাড়িতে চাল ও ফলের সঙ্গে খিচুড়ি ও মিছড়ি-মাখনের নৈবেদ্য দেওয়া হয়। অব্রাহ্মণ পরিবার বলে অন্নভোগ দিতে পারেন না তাঁরা৷ তাই রান্না করা ভোগের বদলে কাঁচা সবজিতে  হলুদ মাখিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হয় ভোগের থালা। আর সব শেষে পানের খিলি। পান পাতার শিরা দিয়ে তৈরি খিলি। দেখতে অনেকটা ঝাড়বাতির মত। তাই তার নাম ঝাড়খিলি। এছাড়া, চারপাশে সাজানো থাকে নানা রকমের পানমশলা। তবে পদ্মের পরিবর্তে ১০৮ টি নীল অপরাজিতা ফুলেই সন্ধিপুজো হয় মিত্র বাড়িতে।

উল্লেখ্য, বাড়ির মেয়েকে সারাবছর পর এই পাঁচদিন পেয়ে রীতিমত হইচই শুরু হয়ে যায় বাড়ির অন্দরমহলে। দশমীর দিন ঠাকুরদালান থেকে ছেলেদের কাঁধে চেপে উঠোনে নামেন উমা। তখনই শুরু হয় বরণ, সিঁদুর খেলা। মেয়েকে বরণ করে ও কানে কানে বলা হয়, ‘আবার এসো মা ৷’ দশমীর দেবীবরণের পর দেবীর মুখে দেওয়া হয় সুগন্ধি ছাঁচিপান আর হাতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় সেই ঝাড়খিলি। প্রথমে দুর্গা, তার পর একে একে অন্য প্রতিমার হাতে। সে কারণে দশমীর দিন মোট ২৭টি পানের ঝাড়খিলি তৈরি করা হয় সকলের জন্য। এই বাড়িতে আজও কাঁধে করে দেবীকে নিয়ে যাওয়া হয় গঙ্গার ঘাটে, আর সেখানেই হয় বিজসর্জন ৷ ধুতি পরে, লাঠি হাতে, খালি পায়ে বাড়ির পুরুষেরা গঙ্গায় বিসর্জন দিতে যান উমাকে। তবে বিসর্জনে বাড়ির মেয়েদের যাওয়ার নিয়ম নেই।

Article by: শুভদীপ রায় চৌধুরী

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)