Saranda Forest, Jharkhand - সারান্ডা ফরেস্ট, ঝাড়খন্ড

Saranda Forest, Jharkhand - সারান্ডা ফরেস্ট, ঝাড়খন্ড

জঙ্গল আমার বরাবরই খুব প্রিয় গন্তব্য । আর এ জঙ্গল তো এশিয়ার সবচেয়ে বড় শালের জঙ্গল । এর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে ছোটো ছোটো আদিবাসী গ্রাম । দারিদ্র্য, না পাওয়া , সরকারী অবহেলা তাদের অভিধানে বহমান চিরকাল । তবু মুখে হাসির কমতি নেই । হাজার না পাওয়াতেও এতটুকুও অভিযোগ নেই । একথা বোধহয় সব জঙ্গলের অধিবাসীদের ক্ষেত্রেই সত্য ।



এ জঙ্গলে ব্রিটিশ আমলে তৈরি ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে । এখন তার ভগ্ন দশা । পাশেই সদ্য নির্মিত নতুন ওয়াচ টাওয়ার । জঙ্গলের দখলদারি রুখতে , খনিতে খনন কাজে বাধা দিতে গিয়ে প্রাণ হারানো আদিবাসী শহিদদের সমাধি রয়েছে রাস্তার পাশেই । অতিবাম কার্যকলাপে একসময়ের কাঠের বন বাংলো ধ্বংস হওয়ার পরে আবার তৈরি হয়েছে কংক্রিটের ঝাঁ চকচকে থালকোবাদ বাংলো । রয়েছে পুরনো ব্রিটিশ আমলের গোলাকার ও ত্রিকোণাকার মাইলফলক । আগেকার লাল মোরামের রাস্তা বেশিরভাগ জায়গায় রূপ বদলে এখন কংক্রিটের ।

কিন্তু ওদের কোন পরিবর্তন সেই অর্থে ঘটেনি । সারাদিনে একটা মাত্র বাস একবার যায় আর একবার ফিরে আসে । জঙ্গলের গ্রাম্য প্রাইমারী স্কুলের মাস্টার আসে সপ্তাহে তিন বা চার দিন । চুনোপুঁটিগুলো সবুজের আঁচলে টাটকা অক্সিজেন নিয়ে খেলে বেড়ায় , ছাগল বা ভেড়া চরায় , যে দিন গুলোয় স্কুল থাকে না।



এখানে রোজ হাট বসে না । দোকান পত্তর নেই , গাড়ি ঘোড়া নেই । শরীর খারাপে ডাক্তার বদ্যি নেই । শুধু মুখে অম্লান নিষ্পাপ হাসি আছে । আধপেটা খেয়ে, কেরোসিনের কুপীর আলোয় , জংলী শ্বাপদের শুকনো পাতা মাড়িয়ে আসা যাওয়ার শব্দ শুনে রাত কাটে ওদের ।

আমরা জঙ্গলের সৌন্দর্য দেখতে যাই । মোহিত হয়ে ফিরেও আসি । এবারে যেমন , জঙ্গলে ভারি বৃষ্টির দর্শন পেলাম । দিনের বেলাতেই এই জঙ্গলের অনেকটা অংশে মাটিতে রোদ পড়েনা বনস্পতিদের ঘেঁষাঘিসি অবস্থানের জন্য । আর বৃষ্টিতে তো মেঘেরা হাত ধরাধরি করে নেমে  আসে জঙ্গলের মাথায় চাঁদোয়া হয়ে ।





ড্রাইভারদের পরামর্শ মেনে আদিবাসী কচিকাঁচাগুলোর জন্য কিছু বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে গিয়েছিলাম । ওরা খুব খুশি । পরে মনে হল, আরও একটু বেশি নিলে ভালো হতো । পরের বার এলে ব্যবহারযোগ্য নতুন-পুরনো জামা কিছু নিয়ে আসব । আপনাদেরকেও বলছি , নতুন না হলেও পুরনো জামা কাপড় পারলে নিয়ে যাবেন জঙ্গলে গেলে । আর কিছু শুকনো খাবার । বিনিময়ে যে খুশি খুশি মুখগুলো দেখতে পাবেন , অনেক অর্থ খরচ করেও তা শহরে পাবেন না ।

বাঙালি আর বেড়ানো যে একে অপরের সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে , এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই । আমরা যেমন ! সুযোগ পেলেই পালাই পালাই করি ! অর্থাৎ,  আমাদের উঠল বাই তো বেড়াতে যাই ।  মানুষের খিদে পায় , ঘুম পায় , তৃষ্ণা পায় ! আর আমাদের মাঝেমাঝেই বেড়ানোতে পায় । আর এই বেড়ানোতে পেলেই ব্যাগ  পত্র গুছিয়ে পাড়ি দিই,  কাছে দূরে বিভিন্ন জানা এবং অজানা স্পট-এ ।

 এবছর আমরা গিয়েছিলাম সারণ্ডা ফরেস্ট , এর আগে দু'বার ঘোরা তবুও আমার কাছে জঙ্গলের  আকর্ষণ বরাবরই অত্যন্ত তীব্র ।  আর এশিয়ার সবচেয়ে বড় শাল গাছের জঙ্গল বেড়াতে যাওয়ার জন্য আলাদা একটা অমোঘ টান তো সবসময় থাকেই । 

একাদশীর দিন ভোর বেলায় অর্থাৎ এবছর  অক্টোবরের 6 তারিখে হাওড়া থেকে,  হাওড়া- বারবিল জনশতাব্দী এক্সপ্রেস ধরে আমরা 23 জনের গ্রুপ নিয়ে পাড়ি দিলাম ওড়িশার খনি শহরের উদ্দেশ্যে । এর আগে 2019 এর জুলাই মাসে আমি আর আমার ভ্রাতৃসম বন্ধু দেবরাজ দুজনে মিলে গিয়েছিলাম সারান্ডা ফরেস্টে । সেবারে উদ্দেশ্য ছিল মূলত পুজোর জন্য ব্যবস্থাপনা করে আসা । 2019 এর অক্টোবর মাসেপুজোর পরে, ছোট-বড় মিলিয়ে 45 জনের দল   নিয়ে আর সাথে ক্যাটারার গ্রুপ আমরা বারবিলের আধার রিজেন্সি হোটেলে গিয়ে উঠেছিলাম । আধার হোটেলের মোট 15 টা রুম আমাদের বুক করা ছিল সেবার ।  এবারে অবশ্য অনেকটাই ছোট গ্রুপ,  ছোট-বড়  মিলিয়ে 23 জনের । যদিও তাতে আমাদের আনন্দের বা উৎসাহের কোন কমতি ছিল না ।


 সকাল ছটা কুড়িতে ছেড়ে জনশতাব্দী এক্সপ্রেস বারবিল পৌঁছলো দুপুর 12:44 টায় । হোয়ার ইজ মাই ট্রেন অ্যাপ-এ বারবার চেক করছিলাম, গত কয়েকদিনে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দেরিতে পৌঁছনো নিয়মে পরিণত করে ফেলেছে এই ট্রেন । অবাক করার বিষয় হল, আমরা গিয়ে পৌঁছলাম নির্ধারিত সময়ের 6 মিনিট আগে ।

 ফলে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতেই হলো । আমাদের হোটেল থেকে পাঠানো গাড়ি স্টেশনে পৌঁছাতেই আমরা সদলবলে মালপত্র নিয়ে পৌঁছে গেলাম আগে থেকে বুক করে রাখা হোটেলে ।  আমাদের বুক করে রাখা সাতটা রুমে ঝটপট পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনুযায়ী ভাগ করে দিলাম । তারপরে আমরা ফ্রেস হয়ে , লাঞ্চ সেরে বেরিয়ে পড়লাম মহাদেব ওয়াটার ফলস এবং বৈতরনী নদীর তীরে মিরিং শৃঙ্গা ঘুরে দেখতে ।


বারবিল শহরের আশেপাশে চোখ মেললেই দেখা যায় লাল ধুলোর অবাধ উড়াউড়ি । বারবিল একটি ছোট্ট খনি শহর । এই শহরের সীমা ছাড়ালেই দেখা যায় পাহাড় জঙ্গল-টিলা আর লৌহ খনি ।  অনেকগুলো আয়রন মাইন রয়েছে এখানে,  যেখান থেকে অনবরত আয়রন আকরিক তুলে মাল গাড়িতে চাপিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন জায়গায় । আবার খনি এলাকার পাশেই রয়েছে অনেক ফ্যাক্টরি, যেগুলোতে খনি থেকে তোলা লৌহ আকরিক পরিশোধিত হয় লোহায় পরিণত হয় ।

মুরগা মহাদেব ওয়াটার ফলস আর মন্দির পাশাপাশি অবস্থিত । শ্রাবণ মাসে এবং চৈত্র মাসে এখানে বেশ বড়সড় মেলা বসে । এখন অবশ্য প্রায় ফাঁকা । মহাদেবের মন্দির এ আমরা প্রবেশ করতে পারলাম না,  মন্দির তালা বন্ধ ছিল । তবে লোহার গ্রিলের এপার থেকে মহাদেবের দর্শন সারতে  আমাদের কোনো অসুবিধা হয় নি ।


 মূল প্রবেশপত্র থেকে সমান্তরালে থাকা দুটো আলাদা সিঁড়ি দিয়ে মন্দিরে এবং ওয়াটারফলসে যাওয়া যায় । ওয়াটার ফলসে যাওয়ার সিঁড়িটি তুলনামূলকভাবে অনেকটা নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত । এই সিঁড়ি দিয়ে একেবারে জলপ্রপাতের সামনে পৌঁছানো যায় । আমরা বিকালের দিকে পৌঁছে ছিলাম তাই স্নান করার কোন উপায় ছিল না, নইলে এখানেই স্নান করার খুব ভালো ব্যবস্থা আছে । যদিও সেই শেষ বিকেলে অনেককে এখানে স্নান করতে দেখলাম ।

এরপর আমরা রওনা দিলাম মিরিং শৃঙ্গার উদ্দেশ্যে । এখানে ছড়িয়ে থাকা এলোমেলো বিশাল বিশাল পাথরের উপর দিয়ে বৈতরণী নদী বয়ে গিয়েছে । অনেকগুলো ছোট ছোট ঝরনা তৈরি হয়েছে । এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ । পাশেই রয়েছে আরেকটি শিব মন্দির । এই মন্দিরেরও বাইরে থেকে তালা বন্ধ ছিল । 


মিরিং শৃঙ্গার  বিশালাকার প্রস্তর-এর উপরে অনেকগুলি বড় বড় ছাপ রয়েছে । স্থানীয়রা মনে করেন ভগবান রামচন্দ্র বনবাসের সময় এই রাস্তা দিয়ে গিয়েছিলেন । তাদের ধারণা এই ছাপ গুলো আসলে , রামচন্দ্র লক্ষণ এবং হনুমানের পায়ের ছাপ ।  আমরা বেশ কিছুটা সময় এখানে কাটিয়ে তারপর হোটেলে ফেরার পথ ধরলাম ।

Post a Comment

Previous Post Next Post