Hangseshwari Temple - হংসেশ্বরী মন্দির এবং বাঁশবেড়িয়া রাজবংশ।।

Hangseshwari Temple - হংসেশ্বরী মন্দির এবং বাঁশবেড়িয়া রাজবংশ।। 

পুরো মন্দিরটি তৈরি হয়েছে তন্ত্রমতে।।

তন্ত্রের গূঢ়তত্ব লুকিয়ে মন্দিরের অভ্যন্তরে।।

আসন্ন কালীপুজো উপলক্ষে আমি পরপর কয়েকটি কালীমন্দিরের কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরেছি। আজ বলবো হংসেশ্বরী মন্দিরের কথা।

গত মহালয়ার দিন আমরা দুই ফেসবুক বন্ধু চলে গিয়েছিলাম বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দির অনন্তবাসুদেবের মন্দির দর্শন করতে।

প্রথমে বলি হংসেশ্বরী মন্দিরের কথা। এইরকম মন্দির বাংলায় আর দ্বিতীয়টি নেই। এই মন্দিরের গঠনশৈলীর মধ্যে নিহিত আছে তন্ত্রশাস্ত্রের গূঢ়তত্ব। কারণ এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা বাঁশবেড়িয়ার রাজা ছিলেন একজন তান্ত্রিক। তাই হংসেশ্বরী মন্দির সম্পর্কে কিছু বলতে গেলেই বাঁশবেড়িয়া রাজবংশের কথা না বললে মন্দিরের রহস্য বোঝা সম্ভব নয়। যা খুবই কৌতূহলজনক।

হংসেশ্বরী মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা বাঁশবেড়িয়া রাজবংশ সম্মর্কে যেটুকু তথ্য পাওয়া যায়, তা সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

এই বংশের আদিপুরুষ দেবদত্ত ছিলেন এক সময়কার সংস্কৃত পন্ডিতদের পীঠস্থান কান্যকুব্জ বা কনৌজের অধিবাসী। তৎকালীন বাংলার রাজা আদিশূরের ( বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে ) আমন্ত্রণ পেয়ে মুর্শিদাবাদে এসে দত্তবাটি প্রতিষ্ঠা করে সেখানে সপরিবারে বসবাস করতে থাকেন।



দেবদত্তের অধস্তন দশম পুরুষ কবি দত্ত তৎকালীন বাংলার শাসনকর্তা লক্ষ্মণ সেনের কাছ থেকে "খান" উপাধি লাভ করেন। কবি দত্তের অধস্তন অষ্টম পুরুষ উদয় দত্ত আপন কৃতিত্বে মোঘল সম্রাট আকবর কর্তৃক জমিদার হিসেবে স্বীকৃতি পান, প্রচুর ভূসম্পত্তি লাভ করেন এবং "সভাপতি রায়" উপাধি লাভ করেন। পরে তিনি শুধু "রায়" উপাধি গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে এই পরিবারের পদবী আগের "দত্ত" থেকে "রায়" হয়ে দাঁড়ায়।

এই ভাবেই এই বংশের জমিদারী চলতে থাকে। পরবর্তী কালে মোঘল সম্রাটদের কাছ থেকে এই বংশের পূর্বপুরুষরা নানা খেতাব এবং অনেক নিষ্কর জমি লাভ করেন। পরে তারা রাজা উপাধি লাভ করেন।

এক সময়ে এই বংশের পূর্বপুরুষ রাঘবেন্দ্র রায় এই বংশবাটি বা আজকের বাঁশবেড়িয়াতে এসে, তখন এখানে ছিলো ঘন বাঁশবনের জঙ্গল, এই জন্য এই অঞ্চলের নাম ছিলো বংশবাটি, এই বাঁশবন কেটে সাফ করে এক প্রাসাদ নির্মান করে বসবাস করতে থাকেন। রাঘবেন্দ্র জমিদারী পরিচালনায় মুগ্ধ হয়ে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব ১৬৭৩ সালে নানা খেতাব সহ ৪০১ বিঘা নিষ্কর জমি ১২টি পরগনার জমিদারী প্রদান করেন।



রাঘবেন্দ্র রায় এই বাঁশবেড়িয়াতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। রাঘবেন্দ্রের মৃত্যুর পরে পুত্র রামেশ্বর এবং রামেশ্বরের মৃত্যুর পর তার পুত্র রঘুদেব এবং রঘুদেবের মৃত্যুর পর গোবিন্দদেব বাঁশবেড়িয়ার রাজা হন। রঘুদেবের ভ্রাতুষ্পুত্র মনোহর রায় বাঁশবেড়িয়া ছেড়ে শেওড়াফুলিতে গিয়ে শেওড়াফুলি রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন।

রাঘবেন্দ্রের পুত্র রামেশ্বর এখানে এক বিশাল দুর্গ এবং তার সামনে এক মাইল ব্যাপী পঞ্চাশ ফুট গভীর পরিখা নির্মাণ করেন। দুর্গকে রক্ষা করার জন্য এক উঁচু দুর্গতোরণ নির্মান করেন। সেই দুর্গতোরণ আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে, ভগ্ন, জীর্ণ বিবর্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আগাছার জঙ্গলে পরিবৃত হয়ে। এবং দুর্গতোরণের পাশেই পরিখার অংশবিশেষ চোখে পড়ে। রাজা রামেশ্বর এখানে পাটুলির মতো বংশের রীতিনীতি মেনে এখানে দুর্গাপুজো, কালীপুজো অন্যান্য অনুষ্ঠান পালন করতে থাকেন। সেই দুর্গাপুজো এখনো চলছে। পুজোর বয়স ৩০০ বছরেরও বেশী। আমরা দুর্গার মূর্তি তৈরি হচ্ছে তা দেখে এসেছি।



ফিরে যাই আগের কথায়, রাজা গোবিন্দদেবের অকাল মৃত্যূতে বাঁশবেড়িয়ার রাজত্বের অনেকটা অংশই তৎকালীন বাংলার আলীবর্দি খাঁর সাথে ষড়যন্ত্র করে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এবং বর্ধমানের রাজা চিত্র সেন দখল করে নেন। বাঁশবেড়িয়া রাজবংশে তখন ঘোরতর দুর্দিন। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কেউ ছিলো না।

রাজা গোবিন্দদেবের মৃত্যুর তিন মাস পর জন্ম হয় নৃসিংহদেবের। রাজা নৃসিংহদেব বড়ো হয়ে তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের কাছে চাকরি পান। ওয়ারেন হেস্টিংসের চেষ্টায় হারানো জমি (১৭৭৯ খ্রী) খানিকটা ফিরে পেলেও, বাকী জমি ফিরে পেতে তাকে লণ্ডনের কোর্টে আবেদন করতে হবে। তা যেমন খরচ সাপেক্ষ তেমনই সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।

এইসব বৈষয়িক জটিলতায় তিনি ১৭৮৯ খ্রীস্টাব্দে এই বাঁশবেড়িয়াতে স্বয়ম্ভবা কালী মন্দির তৈরি করলেন। হংসেশ্বরী মন্দিরের ধ্বংস্প্রাপ্ত ভিত্তিমূল উত্তর পশ্চিম দিকে এখনো দেখা যায়। শুনলাম মায়ের মূর্তিটি নাকি হংসেশ্বরী মন্দিরে রয়েছে।



জমিদারীর কার্যকলাপে আর বৈষয়িক নানা টানাপোড়েনে রাজা নৃসিংহদেব নাজেহাল হয়ে ১৭৯২ খ্রীস্টাব্দে সমস্ত জমিদারী ছেড়ে চলে গেলেন কাশীতে (বেনারসে)

সেখানে তন্ত্রসাধনায় দীক্ষিত সাধু সন্ন্যাসীদের সঙ্গলাভে তিনিও তন্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠলেন। তিনি যোগশাস্ত্রেও দক্ষ হয়ে উঠলেন। তিনি উড্ডীশতন্ত্র নামে একটি গ্রন্থও রচনা করেছিলেন। এর মধ্যে বাঁশবেড়িয়া থেকে তার কাছে চিঠি গেলো যে, লণ্ডন কোর্টে জমি জায়গা নিয়ে মামলা করার খরচ বাবদ কিছু টাকা যোগাড় করা গেছে।

তিনি ফিরে এলেন বাঁশবেড়িয়াতে। কিন্তু মামলা মোকদ্দমার দিকে তিনি গেলেনই না। তিনি মন দিলেন মন্দির নির্মানে।

হংসেশ্বরী মন্দির নির্মানের পরিকল্পনা রচিত হলো। এবং সেটা সম্পূর্ণভাবে রাজা নৃসিংহদেবের মস্তিষ্কপ্রসূত। এই ধরনের মন্দির সারা বাংলায় এর দ্বিতীয়টি নেই।



যোগশাস্ত্রমতে ষটচক্রভেদে আমাদের শরীরে সুষুম্নাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে পাঁচটি নাড়ি রয়েছে। এগুলি হলো, ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুন্মা, বজ্রাক্ষ এবং চিত্রিনী। আবার এই সুষুম্নাকাণ্ড বরাবর বিভিন্ন স্থানে রয়েছে সাতটি চক্র, মতান্তরে ছয়টি। এই চক্রগুলোর একেবারে নীচে রয়েছে মূলাধার চক্র। যেখানে সকল শক্তির আধার বিদ্যমান। যেখানে রয়েছে সর্পাকৃতি "কুলকুন্ডলিনী"

রাজা নৃসিংহদেব মানব শরীরের এই " কুলকুন্ডলিনী" তত্বকেই মন্দিরের স্থাপত্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে চাইলেন।

আমাদের শরীরের পাঁচটি নাড়ির প্রতীক হিসেবে পাঁচতলা বিশিষ্ট তেরোটি চূড়ার সমন্বয়ে হংসেশ্বরী মন্দির নির্মানের পরিকল্পনা করেন। মন্দিরের গর্ভগৃহে, সুষুম্নাকাণ্ডের নীচে যে সর্পাকৃতি "কুলকুণ্ডলিনী" চক্রের



শক্তিরূপে দেবী হংসেশ্বরী মূর্তির পরিকল্পনা তারই।

এই হংসেশ্বরী মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ১৭৯৯ সালে।

বাংলায় সেই সময় অধিকাংশ মন্দির তৈরি হতো সম্পূর্ণভাবে পোড়ামাটির ইঁট দিয়ে। পাথর প্রায় ব্যবহার হতোই না। কারণ বাংলায় পাথর সহজলভ্য নয়।

কিন্তু নৃসিংহদেব মন্দির নির্মানে ইঁট ছাড়াও পাথরের ব্যবহার করেছিলেন। এবং সে পাথর এসেছিলো উত্তরপ্রদেশের চূনার থেকে। আর মিস্ত্রি, কারিগর, শিল্পীরা এসেছিলেন রাজস্থানের জয়পুর থেকে।

যথাসময়ে মন্দির নির্মানের কাজ শুরু হলো। কিন্তু মন্দিরের দ্বিতল ভবনটি তৈরির সময়ই নৃসিংহদেব মারা যান( ১৮০২ খ্রীস্টাব্দে ) তার প্রথমা রানী ভবানন্দময়ী মতান্তরে মহামায়া দেবী সহমরণে যান। কিন্তু তার দ্বিতীয় রানী শঙ্করী দেবী মন্দিরের নির্মানকার্য সম্পন্ন করেন ১৮১৪ সালে। পুরো মন্দিরটি নির্মানে খরচ হয় পাঁচ লক্ষ টাকা।



মন্দির উদ্বোধনের দিন রানী শঙ্করী ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের সাধু, সন্ন্যাসী, ব্রাহ্মণ, পন্ডিতদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তাদের আদর আপ্যায়ন নানা পারিতোষিক দানের মাধ্যমে মন্দিরের পূজার্চনা শুরু হয়।

হংসেশ্বরী মন্দির দক্ষিণমুখী, উচ্চতা ৭০ ফুট। মন্দিরের তিন দিকে বারান্দা সামনে প্রস্তর বাঁধানো প্রশস্ত চত্বর রয়েছে। তন্ত্রমতে তৈরি এই পাঁচতলা মন্দিরের আট কোণায় আটটি, চার কোণায় চারটি মাঝখানে একটি

মোট তেরোটি চূড়া বা শিখর রয়েছে। এই চূড়াগুলো মোচাকৃতি পদ্ম কোরকের আদলে নির্মিত। কেন্দ্রীয় চূড়াটির ওপর রয়েছে ধাতব সূর্য। যার মধ্যে রয়েছে কালীযন্ত্র। এই কালীযন্ত্র হলো সহস্রার চক্রের চাক্ষুষ উপস্থাপনা।

মন্দিরের গঠন, তার স্থাপত্য শৈলী তার অলংকরণ একেবারে বাংলার মন্দিরগুলি থেকে অনেকটাই আলাদা। এই মন্দিরের সাথে রাশিয়ার মস্কো শহরের রেড স্কোয়ার চত্বরে গড়ে ওঠা সুউচ্চ সেন্ট বেসিল ক্যাথিড্রাল চার্চের বাহ্যিক আকৃতির অনেক মিল পাওয়া যায়।

যাইহোক, এই মন্দিরে রয়েছে১৪ টি শিবলিঙ্গ। প্রতিটি শিবলিঙ্গ রয়েছে ছোট ছোট আলাদা আলাদা ঘরে। এবং প্রতিটি ঘরকে যুক্ত করেছে একটা খোলা প্যাসেজ বা বারান্দা। অন্যান্য রত্নমন্দিরের মতো ছাদের প্রতি কোণায় শিখর বসানো নয়। মন্দিরের প্রবেশপথে রয়েছে ত্রিখিলান বিশিষ্ট বারান্দা।

এই মন্দিরে ওপরে ওঠার জন্য রয়েছে পাঁচটি সিঁড়ি। সুষুম্নাকাণ্ডের পাঁচটি নাড়ির আদলে। ওপরে উঠলে শোনা যায় রয়েছে একটা গোলকধাঁধা। যেখানে ঢুকলে অভিজ্ঞ লোকের সাহায্য ছাড়া বেরিয়ে আসা কঠিন। এর গূঢ় অর্থ হলো গুরুর সাহায্য ছাড়া ষটচক্রভেদ সম্ভব নয় এই গোলকধাঁধার মধ্যেই মাঝখানের চূড়াটির নীচে একটি গোপন কুঠুরিতে অবস্থান করছেন শ্বেতপাথরের শিব। ষটচক্রভেদ অনুযায়ী মূলাধারের শক্তিকে পাঁচটি নাড়ির মাধ্যমে চালিত করে হৃদপদ্মে অবস্থিত শিবের সঙ্গে মিলিত হওয়া সম্ভব। হংসেশ্বরী মন্দিরের গঠন সেই নির্দেশই দিচ্ছে।

মন্দিরের গর্ভগৃহের সামনে একটি গোলাকৃতি ফোয়ারা রয়েছে। তাতে জলও রয়েছে দেখতে পেলাম। শুনলাম এই ফোয়ারার সাথে পাশেই ভাগীরথীর যোগাযোগ ছিলো৷ জোয়ারের সময় ফোয়ারাটি জলে পরিপূর্ণ হয়ে উঠতো। তবে এখন আর সে যোগাযোগ নেই। তবে ফোয়ারাটিকে সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো হয়ে থাকে।

এতক্ষণ তো মন্দিরের তৈরির ইতিহাস, গঠনপ্রণালী ইত্যাদি নিয়ে নানা কথা বললাম। এবারে তো আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, এই মন্দিরের নাম হংসেশ্বরী মন্দির কেন হলো বা মায়ের মূর্তির নামই বা হংসেশ্বরী কেন হলো।

এর পেছনেও রয়েছে তন্ত্রশাস্ত্র। মানুষ যখন নিশ্বাস প্রশ্বাস নেয়, তখন হং ধ্বনির সাথে বায়ূ বেরিয়ে আসে এবং ধ্বনির সাথে বায়ূ আবার শরীরে প্রবেশ করে। আর এভাবেই প্রতিটি মানুষ হংস মন্ত্র জপ করে চলেছে। এখানে প্রকৃত বানান হবে " হংসঃ "

হংসোপনিষদ অনুসারে "হং" হলো বীজমন্ত্রস্বরূপ, আর "সঃ" হলো শক্তিস্বরূপ। এই "হংসঃ" মন্ত্রের দ্বারাই হৃদয়ের অষ্টদল পদ্মের মধ্যে হংসাত্মাকে দেখা যায়। হংসেশ্বরী মন্দির এই ভাবনার ধারাই বহন করে চলেছে।

মন্দিরের গর্ভগৃহে অর্থাৎ মূলাধারে হংসেশ্বরী দেবীর অবস্থান। সেই অবস্থানেও রয়েছে তান্ত্রিক মত। একেবারে নীচে পঞ্চমুন্ডির আসনের ওপর রয়েছে শহস্রদল নীলপদ্ম। তার ওপরে অষ্টদল লালপদ্ম। তার ওপরে রয়েছে একটি বড়ো কালীযন্ত্র। যার ওপরে শায়িত মহাকাল, যা পাথরের নির্মিত। এবং এই মহাকালের হৃদয় থেকে উত্থিত দ্বাদশদল পদ্মের বাঁ পা ভাঁজ করে, ডান পা ঝুলিয়ে অবস্থান করছেন দেবী হংসেশ্বরী। দেবী এখানে কালীরূপে পূজিতা হলেও দেবীর জিভ বাইরে বের করা নয়।

দেবীমূর্তিটি সম্পূর্ণ নিম কাঠের তৈরি। কথিত আছে দেবীমূর্তির নিম কাঠ ভেসে এসেছিলো সুদূর বেনারস থেকে। মায়ের গায়ের রঙ নীল বর্ন। দেবী ত্রিনয়নী, চতুর্ভুজা এবং ঘোমটা দেওয়া। দেবীর বাঁদিকের ওপরের হাতে তরবারি, নীচের হাতে নরমুণ্ড। ডান দিকের ওপরের হাতে বর নীচের হাতে অভয়মুদ্রা। দেবীর গলায় মুন্ডমালা। সারা বছরই দেবীকে শান্ত রূপে অর্থাৎ দক্ষিণাকালী রূপে পুজো করা হয়। শুধুমাত্র কার্তিক মাসের দ্বীপান্বিতা অমাবস্যায় মায়ের মুখে একটি রূপোর মুখোশ সোনার জিভ পরানো হয়। আর বছরের এই দিনটিতেই তন্ত্রমতে মায়ের পুজো করা হয়। শোনা যায় ওই দিন গভীর রাতে তান্ত্রিকেরা মায়ের পুজো করেন। মা তখন নিরাবরণ থাকেন। শুধু ফুল অলংকারে সজ্জিত থাকেন মা হংসেশ্বরী। প্রতি বারো বছর বা এক যুগ পরপর দেবীমূর্তির অঙ্গরাগ হয়ে থাকে।

মন্দিরের ওপরের দিকে একটা কালো স্লেট পাথরের প্রতিষ্ঠা ফলক রয়েছে। তাতে উৎকীর্ণ আছে ----

"" শাকাব্দে রস বহ্নি মৈত্রগণিতে শ্রী মন্দিরং মন্দিরং

মোক্ষদ্বার চতুর্দ্দশেশ্বর সমং হংসেশ্বরী রাজিতং

ভূপালেন নৃসিংহদেবকৃতিনারব্ধং তদাজ্ঞানুগা

তৎপত্নী গুরুপাদপদ্মনিরতা শ্রী শঙ্করী নির্মমে।।

শকাব্দ ১৭৩৬।। ""

রানী শঙ্করী দেবীর মৃত্যুর পর বাঁশবেড়িয়া রাজবাড়ীর সম্পত্তি তিন নাতির মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। তৈরি হয় তিনটি তরফ, বড়ো, মেজো ছোট। বড়ো তরফ মেজো তরফের বাড়িগুলি আর নেই। এখন যে বাড়িটি দেখা যায়, সেটি ছোট তরফের জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হবার পর এদের আর্থিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। এখন যারা রাজবাড়ীর বংশধর তাদের আর্থিক অবস্থা শোচনীয়।

তবে রানী শঙ্করী দেবী মৃত্যূর আগে দুই মন্দিরের নামে ( হংসেশ্বরী অনন্তবাসুদেবের মন্দির) মন্দির মন্দির সংলগ্ন জমি দেবোত্তর সম্পত্তি করে যান। তাই এই দুই মন্দির আর রাজবাড়ীর সম্পত্তি নয়। শুধু বিগ্রহ অলংকার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রাজ পরিবারের। দুটি মন্দিরই এখন ভারতীয় পুরাতত্ব বিভাগের দায়িত্বে।

শেষে একটা কথা সংযোজন করে দিই এই রানী শঙ্করী দেবীর নামে ভবানীপুরে একটি রাস্তা আছে রানী শঙ্করী লেন নামে।

 

ভালো থাকবেন সবাই।

Post a Comment

Previous Post Next Post