Anandamoyee Kali Mandir - আনন্দময়ী কালী মন্দির

Anandamoyee Kali Mandir-আনন্দময়ী কালী মন্দির, সুখারিয়া সোমড়াবাজার হুগলী।।
মিত্র মুস্তাফী পরিবার।।

সামনেই কালীপুজো। তাই বাংলার কয়েকটি কালীমন্দির নিয়ে কিছু কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরতেই আমার এই সামান্য প্রয়াস।

এর আগেও দুটি মন্দিরের কথা আমি বলেছি। আজ বলবো এই ধারাবাহিকের তৃতীয় পর্বে আর একটি মন্দিরের কথা।

বাংলায় মোট পাঁচটি পঁচিশ চূড়ার মন্দির রয়েছে। তার মধ্যে একটি মন্দির রয়েছে হুগলীর সোমড়াবাজারের সুখারিয়া গ্রামে। পঁচিশ চূড়া ছাড়াও এই মন্দিরের আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এই মন্দিরটি শাক্ত মন্দির। এই মন্দিরে পূজিত হন মা আনন্দময়ী বা মা আনন্দ ভৈরবী। মা কালীরই একটি রূপ। বাদবাকি চারটি মন্দির কিন্তু বৈষ্ণব মন্দির। সেখানে পূজিত হন রাধা কৃষ্ণ।



এই আনন্দময়ী মায়ের মন্দিরটি ত্রিখিলানযুক্ত দক্ষিণমুখী এবং আগেই বলেছি পঁচিশ চূড়া বিশিষ্ট। মন্দিরের ওপরে তিনটে তল রয়েছে। প্রথম তলে চার কোণায় তিনটি করে মোট বারোটি চূড়া। দ্বিতীয় তলে চার কোণায় দুটি করে মোট আটটি চূড়া। তৃতীয় তলে চার কোণায় একটি করে মোট চারটি, মাঝখানে আরও একটি চূড়া। এটি অপেক্ষাকৃত একটু উঁচু।

বিশাল খোলা প্রাঙ্গনের মাঝে লাল রঙের মন্দিরটি মাটি থেকে প্রায় ছয় ফুট উঁচু ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত, বর্গাকার। উচ্চতা ৭০ ফুট। মন্দিরের পরিমাপ ৩৬ বর্গফুট।  মন্দিরটির সামনের দিকের খিলানে এবং খিলানের ওপরে ও দেওয়ালে রয়েছে টেরাকোটার কাজ। তবে খিলানের দিকে রয়েছে ফুল, লতাপাতার নকশা। খিলানগুলি পলকাটা।  আর দেওয়ালে রয়েছে বিভিন্ন মূর্তি। আলাদা করে আর বলছি না। ছবিগুলো দেখলেই বুঝতে পারবেন। মন্দিরটির গঠনশৈলী এবং অলংকরণ চোখে পড়ার মতন। মন্দিরটির একতলায় তিন দিকে বারান্দা আছে।


মন্দিরটির সামনে বিস্তীর্ণ সবুজ প্রাঙ্গণ, তারপরে আমবাগান। আর এই সবুজ প্রান্তরের দুদিকে আলাদা আলাদা করে একটানা ভিতের ওপর ছয়টি করে মোট বারোটি শিব মন্দির। দুদিকের প্রথমটি পঞ্চচূড়া বিশিষ্ট। বাদবাকি দশটি আটচালা রীতিতে তৈরি। পঞ্চচূড়া বিশিষ্ট ডানদিকের মন্দিরে রয়েছে গণেশের বিগ্রহ। আর বাদবাকিগুলোতে শিবলিঙ্গ।

মন্দিরের সামনের দিকে তিনটি খিলানেই লোহার গ্রীলের গেট। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন তিনটি গেটই বন্ধ ছিলো। মন্দিরের কাছাকাছি সেবায়েত, পুরোহিত কাউকে দেখতে পাইনি। যে কিছু তথ্য সংগ্রহ করবো।


মন্দিরের মাঝের লোহার গ্রীলের গেটে ওপরে ও নীচে বৃত্তাকার ডিজাইনের মধ্যে কিছু তথ্যের উল্লেখ আছে লোহার সরু পাত দিয়ে। ওপরে লেখা, আনন্দময়ী ঠাকুরানী, প্রতিষ্ঠাতা ঁবীরেশ্বর মুস্তাফি, স্থাপিত ১১৭০ সাল ( বোধহয় বঙ্গাব্দ হবে )। আর নীচে ওইভাবেই লেখা,  আনন্দময়ী সেবা কমিটি, সুখারিয়া, ১১৭০ সাল।

আবার মন্দিরের ভিতে দুটি স্বেত পাথরের ফলক আছে। একটি বড়ো, আর একটা ছোট। বড়ো ফলকটির লেখা মুছেই গেছে। কিছু পড়া যায় না। নীচের ছোট ফলকে লেখা, প্রতিষ্ঠাতা স্বর্গীয় বীরেশ্বর মুস্তৌফি। ( পদবীর বানানটা খেয়াল করবেন।) সন ১২২০ সালের পূর্ব্বে।

দেখেই বোঝা যায় এই পরিবারেরই কেউ পরবর্তী কালে এই ফলক দুটি স্থাপন করেন।

একটু আগেই বললাম, নামের সাথে পদবীর বানানটা খেয়াল করবেন। মূস্তৌফি। আমরা সাধারণত মুস্তাফি পদবী শুনতেই অভ্যস্ত। তবে কেন ফলকে লেখা, মুস্তৌফি। এর পেছনে বিরাট ইতিহাস আছে। সে ইতিহাস লিখতে গেলে একটা বই হয়ে যাবে। আমি একটু সংক্ষেপে বলি।




এদের আদি পদবী ছিলো মিত্র। ১৬৫৭ সালে শান্তিপুরের উপাধ্যায় মোহন মিত্র শান্তিপুর ছেড়ে হুগলী নদীর পূর্ব দিকে উলা গ্রামে ( এখনকার বীরনগর গ্রাম) থাকতে শুরু করেছিলেন। এনারা ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত ব্যক্তি। পেশা ছিলো শাস্ত্রজ্ঞানে মানুষকে শিক্ষিত করা। তার পুত্র  রামেশ্বর মিত্রও ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু তিনি শাস্ত্রজ্ঞান চর্চা বা পন্ডিতের পেশা ছেড়ে বাংলার নবাব শায়েস্তা খাঁর অধীনে কোষাধ্যক্ষ এবং হিসাবরক্ষকের চাকরি গ্রহণ করেন। দিল্লীর মসনদে তখন সম্রাট ঔরঙ্গজেব। শায়েস্তা খাঁ ছিলেন সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মামা। ফলে রামেশ্বর মিত্রের কাজের সুখ্যাতি বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে দিল্লীর দরবারে পৌঁছে গেলো। ফলস্বরূপ সম্রাট ঔরঙ্গজেব স্বয়ং ডেকে পাঠালেন রামেশ্বর মিত্রকে। তার কাজের প্রশংসা তো করলেনই আর স্মারক হিসেবে দিলেন তাঁর ডান হাতের সোনার তালুর ছাপ। পাঞ্জা। আর তাদের মুস্তৌফি উপাধি প্রদান করলেন। সঙ্গে দিয়েছিলেন প্রচুর পরিমাণ অর্থ। তাদের পদবীর সাথে মুস্তৌফি শব্দটা যোগ হয়ে, পদবী হয় মিত্র মুস্তৌফি। অবশ্য পরবর্তীতে মুস্তৌফির বানান পরিবর্তিত হয়ে মুস্তাফি'তে পরিণত হয়।



আর দিল্লীর সম্রাট ঔরঙ্গজেবের দেওয়া সোনার হাতের পাঞ্জা, মিত্র মুস্তাফি পরিবারের স্মারক বা প্রতীক চিহ্ন হিসেবে রয়ে গেলো। প্রতি শুভ কাজেই এই পাঞ্জা ব্যবহৃত হতো। এমনকি মিত্র মুস্তাফি পরিবারের নব বধূকে এই পাঞ্জা দিয়েই সিঁদুর পরিয়ে বরণ করে নেওয়া হতো।

যাকগে, ফিরে যাই আগের কথায়, সেই অর্থ দিয়েই নদীয়ার রাজার থেকে উলাতেই জমিদারির স্বত্ব ক্রয় করেন। ভালোই চলছিলো সবকিছু। কিন্তু হুগলী নদী গতিপথ পরিবর্তন করায় ব্যবসা বানিজ্য এবং জমিদারি পরিচালনায় মন্দা দেখা দেয়।

রামেশ্বরের পুত্র রঘুনন্দন ছিলেন জ্যোতির্বিদ। তিনি নদীয়ার রাজার একটা সমস্যার সমাধান করে দেওয়ায় হুগলী নদীর পশ্চিম তীরে আঁটি শ্যাঁওড়া পরগনার বেশকিছু জমি নিঃশুল্ক হিসেবে দান করেন। ১৭০৮ সালে তিনি সপরিবারে চলে আসেন এখানে, এখন যার নাম শ্রীপুর ( বলাগড়, হুগলী )। রঘুনন্দন সাধারণ জীবন যাপন করতে ভালোবাসতেন। তাই তিনি এখানে একটি একতলা বাড়ি তৈরি করে আরাধ্য দেবতা গোবিন্দকে প্রতিষ্ঠা করে তার পূজার্চনা করতে থাকেন। শ্রীপুরে মিত্র মুস্তাফিদের এখনো অনেক কিছুর নিদর্শন আছে। সে অন্য গল্প।



রামেশ্বর মিত্রের বড়ো ছেলে রঘুনন্দন তো শ্রীপুরেই রয়ে গেলেন। কিন্তু রামেশ্বর মিত্রের চতুর্থ পুত্র অনন্তরাম মিত্র মুস্তৌফি ১৭১২ সালে শ্রীপুর ছেড়ে এসে এই সুখারিয়াতে বসতি স্থাপন করেন।

মিত্র মুস্তাফি পরিবার শুধু জ্ঞানে এবং ধনে বড়ো ছিলেন না। তারা ছিলেন প্রকৃত ধর্মপ্রাণ। তাই তারা শ্রীপুরে এবং সুখারিয়াতে অনেক মন্দির নির্মান করেছিলেন, প্রাসাদোপম অট্টালিকার পাশাপাশি।

এই অনন্তরামের নাতি বীরেশ্বর মিত্র মুস্তাফি ১১৭০( ইং ১৮১৩ খ্রীস্টাব্দে )  বঙ্গাব্দের মাঘ মাসের শুক্লা সপ্তমী তিথিতে এই আনন্দময়ী মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মা এখানে ভৈরবী। সেইজন্য অনেকেই এই মন্দিরকে ভৈরবী মায়ের মন্দিরও বলে থাকেন। গর্ভগৃহে উঁচু বেদীর ওপর পঞ্চমুন্ডী আসনের ওপর শায়িত মহাদেবের ওপর মা আনন্দময়ী উপবিষ্টা। বিগ্রহের উচ্চতা প্রায় তিন ফুট।




১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে এই মন্দিরের সর্ব্বোচ্চ পাঁচটি চূড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে সেই চূড়াগুলো আবার নতুন করে নির্মাণ করা হয়।

জনশ্রুতি, অনন্তরাম স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই কষ্টিপাথরের এই মূর্তি উদ্ধার করে মন্দিরে স্থাপনা করেন। জনশ্রুতি আছে মায়েরা তিন বোন। আনন্দময়ী, হরসুন্দরী এবং নিস্তারিণী। তিন বোনের মন্দিরই খুব কাছাকাছি অবস্থিত।

এখানে নিত্য পুজো ছাড়াও দ্বীপান্বিতা অমাবস্যায় বড়ো করে পুজো হয়, আর মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন, মাঘ মাসের শুক্লা সপ্তমী তিথিতেও বড়ো করে মায়ের পুজো হয়।



বড়ো রাস্তা থেকে পূর্বমুখী সরু রাস্তায় যখন আমাদের টোটো প্রবেশ করলো, দেখলাম ডান হাতে বিশাল দীঘি৷ বাঁ হাতে ভগ্ন, জীর্ন, বিবর্ন দ্বিতল মিত্র মুস্তাফি পরিবারের প্রাসাদোপম অট্টালিকা। যে বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই বংশের সুযোগ্য সন্তান রাধাজীবন মিত্র মুস্তাফি। যার নামানুসারে বাড়িটির নাম, রাধাকুঞ্জ। একটি প্রস্তর ফলকে তা দেওয়ালে লাগানো আছে।

এই বাড়িতেই ১৯৮১ সালে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রপরিচালক মৃনাল সেন তাঁর, আকালের সন্ধানে, ছবির শুটিং করেছিলেন। এই বাড়ির ভেতরটা দেখার জন্য মনটা ছটফট করলেও আমাদের আশা পূরণ হয়নি। কারণ বাড়ির সামনের দিকের তিনটি দরজাতেই তালা দেওয়া। এবং তালাগুলো খুব চকচকে। বোঝাই যায় মাঝে মাঝে এই তালা খোলা হয়। পাশেই একটা পরিবারের বাস। তাদের থেকে যেটুকু জানতে পারলাম, আগে এই বাড়ির চাবি তাদের কাছেই থাকতো। কিন্তু এখন কার কাছে থাকে তা তারা জানেন না, বললেন। বুঝতেই পারলাম এই তালাচাবি নিয়ে বিতর্ক এড়াতেই তাদের এই মন্তব্য। নাহলে যারা এই বাড়ির পাশে থাকেন অথচ চাবি কার কাছে থাকে তা তারা জানেন না, এটা হতে পারে না। তাছাড়া তালাগুলো যদি জংধরা, মরচে পড়া হতো, তাহলেও একটা কথা ছিলো।


তাই খুব আশা করে গিয়েছিলাম, বাড়ির ভেতরটা দেখতে পাবো বলে। সে আশা অপূর্ণই থেকে গেলো। ভেতরে প্রতি বছর দুর্গাপুজো হয়। তখন এই বাড়ি খোলা থাকে। তখন একবার এসে দেখার ইচ্ছে রইলো। সত্যিই ভেতরটা দেখবার মতো।

এই বাড়িটা পেরিয়ে ডান হাতে আনন্দময়ী বা আনন্দ ভৈরবীর মন্দির।

পোস্টটা একটু বড়ো হয়ে গেলো। কি আর করা যাবে। মন্দির নিয়ে লিখবো আর মন্দিরের ইতিহাস নিয়ে লিখবো না তাতো হয় না। তাছাড়া প্রচুর কৌতুহলী পাঠক আছেন, তারাও জানতে চান, তাই তাদেরকে বঞ্চিত করি কি করে!

ভালো থাকবেন সবাই।।

Author: Samiran Chandra Banik

Post a Comment

Previous Post Next Post