Rokkini Debi Mondir। Ghatshila Tour | ঘাটশিলা ভ্রমণ | রঙ্কিণী দেবীর মন্দির

Rokkini Debi Mondir। Ghatshila Tour | ঘাটশিলা ভ্রমণ | রঙ্কিণী দেবীর মন্দির

রহস্য রোমাঞ্চ কিংবদন্তীতে ঘেরা এই মন্দির।।

যে মন্দির নিয়ে গল্প লিখেছেন বিভূতিভূষণ।।

আমরা ঘাটশিলা বেড়াতে গিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম রঙ্কিনী দেবীর মন্দিরে। ঘাটশিলা থেকে গাড়িতে প্রায় এক ঘন্টার দূরত্বে জাদুগোড়ায় পাহাড়ের গায়ে রাস্তার ধারে এই মন্দির।

দক্ষিন ভারতীয় শৈলীতে নির্মিত এই মন্দিরে লম্বা গোপুরম রয়েছে। তাতে দেবী রঙ্কিণীর নানারূপ স্ট্যাকোর আদলে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মন্দিরের প্রবেশপথের ওপরে বেশ বড় আকারেই দেবী দুর্গার দশপ্রহরণধারিনী অসুরদলনী মূর্তি নজরে পড়বে। তাছাড়া অন্যান্য দেব দেবীর মূর্তি রয়েছে। রয়েছে দশমহাবিদ্যার মূর্তি।

মন্দিরের গর্ভগৃহে কোনো মূর্তি নেই। একটি বড়ো কালো রঙের পাথরকে দেবী রঙ্কিণী হিসেবে পুজো করা হয়। মন্দিরের দুপাশে আছে দুটি মন্দির। একটি গণেশের আর একটি মহাদেবের।

মন্দিরটি যেহেতু একটি ব্যস্ততম রাস্তার ধারে অবস্থিত তাই মন্দিরের সামনে মোটা লোহার রেলিঙ রয়েছে। রেলিঙের ভেতরে ঢুকে নিশ্চিন্তে পুজো দেওয়া যায়। গর্ভগৃহে সবসময়ই একজন পূজারী থাকেন। রাস্তার অপর পাড়েও মোটা লোহার রেলিঙ রয়েছে। আর পাহাড় বলে গাছপালাও আছে। মন্দিরে যারা পুজো দিতে আসেন তারা মনস্কামনা পূরণের উদ্দেশ্যে লাল কাপড়ে বাঁধা নারকেল ওই লোহার রেলিঙে বা গাছে বেঁধে দেন। রেলিঙে সারি সারি লাল কাপড়ে মোড়া নারকেলগুলো দেখলে বোঝা যায় রঙ্কিণী দেবীর ওপর মানুষের বিশ্বাস আর ভক্তি কতটা গভীর।

রঙ্কিণী দেবী কালীরই একটি অবতার এবং এই অঞ্চলের উপজাতি শ্রেণীর মানুষদের দ্বারাই সাধারণত পূজিত হন। এখানকার ভূমিজ সম্প্রদায়ের মানুষেরাই এই মন্দিরের পুরোহিত হবার যোগ্য। উপজাতি শ্রেণীর মানুষ ছাড়াও স্থানীয় মানুষ এবং বহু দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এখানে পুজো দিতে আসেন। তাই প্রতিদিনই প্রায় সবসময়ই মন্দিরে ভীড় লেগেই থাকে। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখনও মন্দিরে পূন্যার্থীদের ভীড় লক্ষ্য করেছি। মন্দিরে নিত্য পুজো ছাড়াও দুর্গাপুজো ও কালীপুজো অনুষ্ঠিত হয় সাড়ম্বরে। স্বাভাবিক ভাবেই ওই সময় ভক্তদের ভীড় বেশী হয়। মানুষের বিশ্বাস মা রঙ্কিণী দেবী খুবই জাগ্রত, এখানে পুজো দিলে তার মনস্কামনা পূর্ণ হবেই।

এই রঙ্কিণী দেবীকে নিয়ে বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা রোমাঞ্চকর লোমহর্ষক গল্প আছে। যার নাট্যরূপ "সানডে সাসপেন্স"-এ অনেকেই শুনেছেন।

এছাড়াও এই মন্দির নিয়ে একটা লোককথা প্রচলিত আছে।

একটা সময়ে এই অঞ্চলটা ছিলো জঙ্গলে পরিপূর্ণ। সেই জঙ্গলে এক আদিবাসী মানুষ কাঠ কুড়ানোর সময় দেখেন যে একটি মেয়ে একটি দৈত্যকে হত্যা করছে। তিনি সেই দৃশ্য দূর থেকে দেখে ভয় পেয়ে যান। এবং নিজেকে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে ফেলেন। পরে মেয়েটি যখন ফিরে যাচ্ছে তখন আদিবাসী মানুষটি ওই মেয়েটির সামনে গেলে মেয়েটি অদৃশ্য হয়ে যায়। সেইদিন রাতে মেয়েটি তাকে স্বপ্নে দেখা দেয় এবং নিজের পরিচয় দিয়ে ওই অঞ্চলে একটি মন্দির তৈরি করে সেখানে তার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে তার নিত্যপুজোর নির্দেশ দেয়।

তবে সেই সময় কিরকম মন্দির তৈরি হয়েছিলো বা কবে হয়েছিলো সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। ববর্তমানে যে মন্দিরটি আমরা দেখতে পাই তা তৈরি হয়েছিলো ১৯৫০ সালে।

এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশও খুব মনোরম। বন জঙ্গল, পাহাড় আর এই মন্দির সব মিলিয়ে ভালোই লাগে। তবে মন্দিরের সামনে ব্যস্ততম রাস্তা না থেকে যদি চারিদিকে গাছপালা সহ বন্য পরিবেশ থাকতো তবে একটু গা ছমছমে ব্যাপার উপভোগ করা যেতো। সেই পরিবেশটা এই মন্দিরের সাথে বেশ মানানসই হতো।

তবে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা নিয়ে আরেকটা কাহিনী প্রচলিত আছে।

আনুমানিক তেরশো খ্রীস্টাব্দে রাজস্থানের ধার ও মান্ডু অঞ্চলে নৃপতি জগন্নাথদেব নামে এক আঞ্চলিক রাজা ছিলেন। তার রাজ্যে মুসলিম আক্রমণ শুরু হলে তাদেরকে প্রতিরোধ করতে না পেরে তিনি নিজের রাজ্য ছেড়ে অপেক্ষাকৃত নিশ্চিন্তে ও নিরাপদে থাকার জন্য লোক লস্কর নিয়ে চলে আসেন বর্তমান ঝারখণ্ডের এই অঞ্চলে। তখন এখানে ঘন জঙ্গল। এই জঙ্গলে বাস করতো মুণ্ডা উপজাতির দল। ঐতিহাসিকদের মতে যারা ছিলো প্রোটো অস্ট্রালয়েড শ্রেণীর মানুষ, যারা নিজেদেরকে অসুরের বংশধর রূপে ভাবতো এবং তারা কালীর উপাসক ছিলো।

রাজা নৃপতি জগন্নাথদেব রাজ্যস্থাপন ও রাজ্য শাসনের পাশাপাশি ধর্মেকর্মেও মন দিয়েছিলেন। রঙ্কিণী দেবী হলেন রাজপুতদের প্রধান আরাধ্যা দেবী। দেবী দুর্গারই একটি রূপ। রাজা নৃপতি জগন্নাথদেব এখানে রঙ্কিণী দেবীর মন্দির স্থাপন করেছিলেন। যা ছিলো স্থানীয় আদিবাসী মানুষদের জীবনযাত্রা ও চিরাচরিত সংস্কৃতির পরিপন্থী।

রাজা জানতেন যে স্থানীয় মানুষরা এই দেবী এবং মন্দিরকে মেনে নেবে না। কারণ তারা নিজেদেরকে অসুরের বংশধর বলে মনে করতো, যেটা আগেই বলেছি। তাই তারা দেবী দুর্গার এই অসুর নিধন মূর্তিকে কিছুতেই সহ্য করবে না। আর তারা ছিলো মা কালীর ভক্ত৷

রাজা নৃপতি জগন্নাথদেব তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে মা দুর্গা এবং মা কালী একই দেবীর দুই রূপ। তিনি তাদেরকে অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে এই পুজো মন্দিরের সাথে তাদের যুক্ত করে দেন।

পূর্বে এই মন্দিরের পুজোয় পশুবলি থেকে নরবলি সব হতো। পরবর্তী কালে সেসব বন্ধ হয়ে যায়।

রাজা নৃপতি জগন্নাথদেবও নাম পরিবর্তন করে নৃপতি জগন্নাথ ধলদেব উপাধি গ্রহণ করেন। এবং তাঁর শাসিত অঞ্চলের নাম হয় ধলভূমগড়।

এছাড়াও এই রাজবংশের কোনো রাজা পরবর্তীতে ঘাটশিলা শহরের মধ্যেই রঙ্কিণী দেবীর মন্দির স্থাপন করেন। তবে সেখানেও শীলারূপী কালীমূর্তির নিত্যপূজা হয়। তবে সে মন্দির একদম ঝাঁ চকচকে। বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে। বেশ ভালোই লাগে।

এবারে রঙ্কিণী দেবীর মন্দিরের আর একটা ইতিহাসের কথা বলি।  আসলে ইতিহাস মানেই বোধহয় বিতর্ক, ইতিহাস মানেই মতভেদ। এখানেও তাই।

আসলে ধলভূম এক সময়ে একটা স্বাধীন রাজ্য ছিলো। ধলভূমের রাজাদের অধীনস্থ অঞ্চলটিকে বলা হতো ধলভূমগড়। ১৮৩৩ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত এই ধলভূমগড় মেদিনীপুর জেলার জঙ্গল মহলের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। শোনা যায় রঙ্কিণী দেবীর বরে স্থানীয় এক রজক বা ধর এই অঞ্চলের রাজা হয়ে এক ব্রাহ্মনের কন্যাকে বিবাহ করেন। এদের বংশধরদের বলা হতো ধবলদেব।

অতীতে ধলভূমগড়ের রাজধানী ছিলো ঘাটশিলা। এই ধলভূমগড়ের কোনো রাজাই ঘাটশিলাতে রঙ্কিণী দেবীর মন্দির তৈরি করেন। এই রঙ্কিণী দেবীই ধলভূম রাজবংশের আরাধ্যা দেবী ছিলেন।

যাইহোক ইতিহাস, ইতিহাসের জায়গায় থাক আমরা বরং ছবির মাধ্যমে মন্দির দর্শন করি।

ভালো থাকবেন সবাই।

1 Comments

Previous Post Next Post