দশমীর দিন মাছ খেয়ে উমাকে বরণ করেন রায় বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির মহিলারা
প্রায় তিনশো বছরেরও
বেশি সময় ধরে এই বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। প্রাচীন রীতিনীতিকে অক্ষুণ্ণ রেখে আজও
ধারাবাহিকভাবে শারদীয়া মহোৎসব পালন করে আসছেন পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের মানুষেরা।
এই বংশের আদি পুরুষ কেশব চক্রবর্তীর বংশধর রাধাকান্ত চট্টোপাধ্যায় পাথুরিয়াঘাটায় এসে
একটি কুটির নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন। সেই সময় এই বংশে নুনের ব্যবসা এতটাই জনপ্রিয়
হয় যে, রাধাকান্ত সেই ব্যবসার মুনাফা দিয়েই এই বাড়িটি নির্মাণ করেন, যার বর্তমান নাম
'হরকুটির'। এই বিষয়ে কথা হল পরিবারের সদস্য অর্চিষ্মান রায় বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
তিনি জানালেন, বংশের সুসন্তান রাধাকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগেই বাড়িতে প্রথম দুর্গাপুজো
শুরু হয়। সেকালে রাধাকান্তের প্রায় আড়াইশোটি নৌকা ছিল, যা দিয়ে নুনের ব্যবসা চালাতেন
তিনি। বলাবাহুল্য, তাঁর কোন পুত্র সন্তান না থাকায় তাঁর কন্যার সঙ্গে বিবাহ হয় ঈশানচন্দ্র
বন্দোপাধ্যায়ের।
প্রসঙ্গত, 'হরকুটির' এ প্রতিষ্ঠিত আছেন সিদ্ধেশ্বর মহাদেব এবং শ্রীধর জিউ। তাঁদের নিত্য অন্নভোগ সেবা হয়। ঈশানচন্দ্রের পুত্র গঙ্গানারায়ণ বিদ্যায় ও মৃদঙ্গে পারদর্শী ছিলেন। গঙ্গানারায়ণের পুত্র হরপ্রসাদ বন্দোপাধ্যায় বাংলা, সংস্কৃত, ফার্সি, ইংরাজি, ফরাসি, লাতিন ইত্যাদি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। এছাড়া সঙ্গীত জগতে বিশেষ খ্যাতি অর্জনও করেছিলেন। অবতারপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শেও আসেন হরপ্রসাদ। উল্লেখ্য, গঙ্গানারায়ণের কাছে ধ্রুপদ ও সরস্বতী বাইয়ের কাছে রাগসঙ্গীতের তালিম নেন হরপ্রসাদ। এছাড়া কোচবিহার রাজদরবারের শিল্পী কৃষ্ণধন বন্দোপাধ্যায়ের কাছেও গানের তালিম নেন তিনি। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, বীণাবাদনে সবচেয়ে বেশি পারদর্শী ছিলেন হরপ্রসাদ। এই পরিবারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে যদুভট্টের স্মৃতি। একদা এই বাড়িতে ভিয়ানের ব্রাহ্মণ হয়ে এসেছিলেন। পরে সঙ্গীতে তাঁর বিরল প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে উপযুক্ত সম্মান দেয় এই পরিবার। এছাড়া এই বাড়িতে আসেন শ্রীরামকৃষ্ণ, মোহনানন্দ ব্রহ্মচারী প্রমুখ।
এইং বাড়িতে কাঠামো
পুজো হয় জন্মাষ্টমীর পরের দিন এবং দেবীর বোধন হয় প্রতিপদের দিন।রায় বন্দ্যোপাধ্যায়
বাড়ির দুর্গাপুজো হয় কালিকাপুরাণ মতে। দেবী দুর্গার সংসারে লক্ষী-সরস্বতীর কোনও বাহন
থাকে না। পুজোর ভোগে থাকে খিচুড়ি, সাদাভাত, পাঁচভাজা, বিভিন্ন রকম তরকারি, পায়েস ও
চাটনি। রাতে লুচি ও ভাজা দেওয়া হয়। দশমীতে হয় পান্তা-ভাত।দশমীতে মাছ-ভাত খেয়ে সধবা
মহিলারা দেবীকে বরণ করেন এই বাড়িতে। পরিবারের গৃহকর্ত্রী বরণের পরে আর দেবীর মুখ কেউ
দেখেন না। তিনি একটি ঘরে দেবীর উল্টোদিকে একটি আসনে বসে একটি পাত্রে দইয়ের মধ্যে হাত
ডুবিয়ে বসে থাকেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত বিসর্জন সুসম্পন্ন হয়। এই পরিবারে আজও কনকাঞ্জলি
প্রথা রয়েছে। পরিবার সূত্রে খবর, এ বাড়ির পুজোয় প্রতিমা শিল্পীরা বংশ পরম্পরায় আসেন
শান্তিপুর থেকে। ঠিক তেমনই ডাকের সাজের শিল্পী ভূতনাথ মালাকার আসেন বর্ধমানের পাটুলি
থেকে। আর ঢাকিরাও বংশপরম্পরায় আসেন জয়রামবাটি
থেকে।
Article by: শুভদীপ রায় চৌধুরী
Image courtesy: অর্চিষ্মান রায় বন্দ্যোপাধ্যায়