Rikshawala (রিক্সাওয়ালা) - Bengali Story

0

পথ চলতি ঘটনা - ভৌতিক ছোটগল্প

লেখক: অরিন্দম ঘোষ

সময়টা সকাল সাতটা হবে, রবিবার বিশেষ একটা কাজে গড়িয়া বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছিলাম। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগেই মনস্থির করেছিলাম আজ হেঁটে যাবো এবং হেঁটে ফিরবো। স্বল্পক্ষণের একটা কাজ, মিনিট পনেরো থেকে কুড়ি মিনিট খুব বেশী হলে লাগবে আর যেতে আসতে যেটুকু সময় লাগে। আমার বাড়ি থেকে গড়িয়া মোড় পর্যন্ত রিক্সা এবং অটো দুইই চলে। বাইরে ফুরফুরে হাওয়া গতকাল বৃষ্টি হয়েছে। সকালে রাস্তায় গাড়ির চাপও কিছুটা কম থাকে। ফাঁকা রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করেছি বেশ ভালো লাগছে মাস্ক পকেটে রেখে বিশুদ্ধ অক্সিজেন নিতে নিতে হেঁটে চলেছি হঠাৎ একটা কথা মাথায় আসতেই আপন মনে হেঁসে ফেলেছি। হাঁসিটাকে থামানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিলনা কারণ এরকম ক্ষণ জীবনে সবসময় আসেনা। হা হা করে হাসতে হাসতে কিছুটা পাগলের মতোই হাঁটছি এমন সময় উল্টো দিক থেকে আসা একজন কম বয়সী রিক্সাওয়ালা আমাকে দেখে একগাল হাঁসি মুখে বলে উঠলো 'যাবো?' আমিও হাঁসতে হাঁসতে উত্তর দিলাম 'যাও' আমাকে হাঁসতে দেখে মজা করেছে ভেবে আমিও একটু মজা করলুম। কিছুটা এগিয়েছি দেখি সেই ছেলেটি রিক্সা ঘুরিয়ে আমার কাছে চলে এসেছে। ছেলেটির মুখে ঠিক একই রকম হাঁসি। মাথায় হলুদ রঙের টুপি। আমার কাছে এসে 'দাদা যাবে?' বললো। আমি বললাম 'আজ হেঁটে যাবো' যদিও আমি ওকে চিনিনা আবার ছেলেটিও আমাকে চেনেনা। আগে কখনও ওর রিক্সায় উঠেছি বলে আমার খেয়াল নেই।ওকে বললাম, 'আমি ভাবলাম তুমি মজা করছ তাই আমিও একটু মজা করলাম। তুমি তো উল্টো দিকে যাচ্ছিলে, আমি তোমাকে ডাকিনি।' ছেলেটি 'আচ্ছা' বলে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। ওর চোখে মুখে কিন্তু এতটুকু বিরক্তি নেই বরং একটা প্রসন্ন ভাব লক্ষ্য করলাম। আমি দাঁড়িয়ে থেকে ওর রিক্সাটা ঘোরাতে সাহায্য করলাম কারণ তখন দুটি মোটর সাইকেল এসে গিয়েছিল। তার মধ্যে একটি মোটরসাইকেলের চালক আমার পাড়ায় থাকে। যতীন দা কেমন একটা ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে চলে গেল। এরপর যে যার গন্তব্যে চলে গেলাম। ঘটনাটা এখানেই শেষ নয়।

মিনিট কুড়ি পর হেঁটে ফিরছি। বাড়ির অনেকটাই কাছে চলে এসেছি। দেখলাম সেই ছেলেটি রিক্সাটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে হাঁসছে। আমিও হেঁসে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, 'এখানে দাঁড়িয়ে আছো?' বললো 'ভাড়া নিয়ে এসেছি দাদা' সবসময় এরকম হাঁসিমুখ আমি খুব কমই দেখেছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'কোথায় থাকো?' হাঁসি মুখে বললো, 'সোনারপুরে থাকি। মা কে নিয়ে আসি রিক্সা করে। মা আতাবাগানে কয়েকটি বাড়িতে কাজ করে।' দু তিনজনের নামও বললো যাদের বাড়িতে ওর মা কাজ করেন। আমি তাদের মধ্যে একজনকে চিনি কারণ আমি গড়িয়া আতাবাগানে প্রায় তিন বছর ভাড়া ছিলাম। আমি যে বাড়িতে ভাড়া ছিলাম সেটার সংলগ্ন বাড়ির পাশ দিয়ে সরু গলি চলে গেছে। সেই গলি ধরে এগিয়ে গেলে তিন নম্বর বাড়িতে ওর মা রান্নার কাজ করতে আসেন। খুব ভালো মনে নেই তবে টুকরো টুকরো স্মৃতি ভেসে উঠছে সেই সময় ওই বাড়ির কাজের মহিলার একমাত্র ছেলে পথ দুর্ঘটনায় মারা যায় এরকম ধরনের একটা খবর শুনেছিলাম। তারপর সেই মহিলাটি বদ্ধ পাগলে পরিনত হন। যাইহোক হতে পারে তারপর অন্য কাজের লোক রেখেছে। ছেলেটি হাঁসতে হাঁসতে বললো, 'আমি টিফিন নিয়ে এসেছি। মাকে নিয়ে দুপুর একটা দেড়টা নাগাদ বাড়ি ফিরে যাবো।' আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'বিকেলে আবার বেরোও?' বললো, 'না, আর বেরোই না।' ছেলেটির মুখে সবসময় হাঁসি লেগে রয়েছে। আমাকে বললো, 'দাদা পাঁচশো টাকা খুচরো দেবে। ওই ছেলেটিকে ভাড়া নিয়ে এসেছি। ওর কাছে পাঁচশো টাকার নোট।' ওখানে পরপর চারটে দোকান আছে। রবিবার সকালে একটাও দোকান খোলেনি। একটি ছেলে দোকানের সামনে বসে আছে ছোট একটি গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে। গ্যাস রিফিল করাবে। কেবল একটা পাঁচশো টাকার নোট নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওর রিক্সায় উঠেছে। ভেবেছিল গ্যাস রিফিল করিয়ে যা ফেরত পাবে সেই দিয়ে রিক্সা ভাড়া দেবে। এখন অগত্যা দোকান খোলার অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। এই সকালে কেই বা পাঁচশো টাকা খুচরো দেবে। আমি পার্সটা খুলে দেখলাম খুব বেশী তিনশো টাকা খুচরো হতে পারে, বাকি পাঁচশো টাকার নোট। তখন ঘড়িতে .২০। দোকান গুলো সাড়ে সাতটা নাগাদ খোলে। রবিবার একটু দেরিতেই খোলে।

এরপর ছেলেটি নিজে থেকেই বললো, 'আমি আগে পাটুলি গ্যাসের অফিসে কাজ করতাম। গ্যাসের কাজ! প্রচুর টাকা কামাতাম তখন। একবার এক বন্ধুর সাথে বাইকে বারুইপুর গিয়েছিলাম ধাবাতে খেতে। ফেরার সময় লরিতে ধাক্কা লাগে। আমরা দুজন রাস্তায় ছিটকে পরি। বন্ধু আর ওঠেনি। আমার জ্ঞান চলে যায়। হাসপাতালের বেডে জ্ঞান ফেরে। এই দেখো বলে নিজের মাথা থেকে টুপিটা খোলে। আমি রীতিমত চমকে উঠি। আমি কি দেখছি! ওর মাথার খুলিটা অসম্ভব ধরনের বাঁকা। কানের পর থেকে মাথার উপরের দিকটা বেঁকে ভেতর দিকে ঢুকে গেছে। একটা বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে ওই জায়গায়। আমার সারা শরীরটা কেমন যেন গুলিয়ে উঠলো। ছেলেটি আবার হাঁসি মুখে বলতে লাগলো, 'তিন চার বছর বাড়ি থেকে বেরতে পারতাম না। কিছু মনে থাকতো না। এখন মনে থাকে তবে মাঝে মাঝে ভুলে যাই।' ওর কথাটা শোনার পর থেকে বুঝতে পারছি আমার ভেতরটা কেমন একটা হচ্ছে। বুকে একটা চাপ অনুভব করছি। দিনের বেলা চেনা পরিবেশ হলেও আমার কাছে কেমন যেন অচেনা মনে হচ্ছে। আমি কি অন্য কোনো ডাইমেনশনে চলে এসেছি? এটা তো আমার পরিচিত জগৎ নয়। আশেপাশের রাস্তার লোকজন আমার দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে দেখছে। নিজেকে কোনোমতে সামলে নিলাম। রিক্সাওয়ালা ছেলেটিকে বললাম, 'তুমি আরেকটু অপেক্ষা করো, দোকান খোলার সময় হয়ে গেছে। আমি এবার আসি।' এই বলে যেই হাঁটতে শুরু করেছি হঠাৎ একটা আওয়াজে পেছন ফিরে যা দেখলাম, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। রিক্সাওয়ালাটি গায়েব। দোকানের বাইরে গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে বসে থাকা সেই ছেলেটিকেও দেখতে পেলাম না অথচ কেবল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওরা দুজন কোথায় চলে গেল? রাস্তা সোজা চলে গেছে ওখানে কোনো বাঁক ছিলনা। রিক্সাটা যদি রাস্তা দিয়ে যেত তাহলে অবশ্যই দেখা যেত। তাহলে আমার সাথে এতক্ষণ যেটা ঘটলো সেটা কি ছিল?

ব্যাপারটা কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না আর ঠিক তখনই পাড়ার যতীন দা মোটর সাইকেলটা নিয়ে আমার পাশে এসে থামলো। সকালে যাবার সময় আমার দিকে বিস্ময়কর চোখে তাকিয়েছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, 'তুমি একা একা আমাদের বাইক দুটো সাইডে যাবার জন্য হাত দেখাচ্ছিলে কেন?' আমার গলাটা শুকিয়ে আসলো। তার মানে রিক্সাটা ওরা দেখেনি। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে কোনোভাবে কথাটা এড়িয়ে গেলাম। পুরো ব্যাপারটাই ওনার কাছে হাস্যকর হবে সেই ভেবে চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে করলাম। এরপর আস্তে আস্তে বাড়ি ফিরলাম। মনের মধ্যে কয়েকটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। ওরা দুজন কি অশরীরী? কিছুক্ষণের জন্য একটা মায়াবী রূপ ধারণ করেছে? আজ রিক্সায় উঠবো না সেটা কি আগে থেকে জানতো? আমার কাছে খুচরো নেই সেটাও কি জানা ছিল? কেবল আমার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে অদৃশ্য হয়ে গেল?

এবার আমার ধীরে ধীরে সব কথা মনে পড়ে গেল। বছর সাতেক আগের ঘটনা তখন আমি আতাবাগানের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকি। নীচের তলায় দুটো ঘর ভাড়া দেওয়া হত। একটি ঘরে আমি থাকতাম। পাশের ঘরে অন্য একটি পরিবার থাকতো। উপরের তলায় বাড়িওয়ালা থাকতেন। বাড়িটা একটা গলির ভেতর ছিল। ওই গলি দিয়ে বেরিয়ে প্রথম দুটো বাড়ির পর একটা একতলা বাড়ি ছিল। ওটা ছিল নন্দী বাবুর বাড়ি। রিক্সাওয়ালা ছেলেটি নন্দী বাবুর কথাই বলেছিল। পুরো ছবিটা এখন চোখের সামনে ভেসে আসছে। ওনার বাড়িতে রান্নার জন্য একজন  মহিলা আসতেন সোনারপুর থেকে। আমি জানি তার কারণ আমিও একবার ভেবেছিলাম রান্নার জন্য ওনাকে রাখবো। মহিলাটির সাথে একবার কথাও হয়েছিল তারপর যেকোনো কারণেই হোক সেটা হয়নি। ওনার ছেলে পাটুলির গ্যাসের অফিসে কাজ করতো শুনেছিলাম নন্দীবাবুর কাছে। সবে আতাবাগানে এসে প্রথম নন্দী বাবুর সাথে পরিচয় হয়। গ্যাস সিলিন্ডার এর জন্যে ছেলেটিকে বলে ব্যাবস্থা করে দেবেন বলেছিলেন। তারপর আর দরকার হয়নি। বাড়িওয়ালা ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলেন। পথ দুর্ঘটনায় মহিলার একমাত্র ছেলে তার বন্ধু দুজনেই মারা যায় শুনেছিলাম। তারপর আর ওনাকে কাজ করতে আসতে দেখিনি। কিছু কিছু ঘটনার কোনো ব্যাখ্য হয়না। আমি নিজেও জানিনা সেদিন আমার সাথে কি ঘটেছিল। সাত বছর পর হঠাৎ এসব ঘটার পেছনে কারণ কি ছিল? আমাদের আশেপাশে এরকম অনেক আত্মা হয়ত ঘোরাফেরা করছে। কিছু হয়ত বলতে চাইছে। আপনাদের কাছে যদি কোনো ব্যাখ্যা থাকে জানাবেন।।

--সমাপ্ত--

আংশিক সত্যের সাথে কল্পনার মিশ্রণে গল্পটি লেখা।

লেখকঅরিন্দম ঘোষ

Tags

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)