পশ্চিম বর্ধমানের নবগ্রামে ব্যাঘ্রবাহিনী দুর্গার আরাধনা হয়, সন্ধিপূজায় হয় শ্বেতছাগ বলি
বর্ধমান:
শারদোৎসবের আনন্দ চেটেপুটে উপভোগ করতে তৈরি উৎসবপ্রিয়
বাঙালি। সারাবছরের অপেক্ষার শেষ হতে চলেছে,
কারণ উমা ঘরে ফিরছেন।
দেবী সমস্ত স্থানে সিংহবাহিনী দশভুজা হলে বঙ্গ এবং
তার বাইরে ব্যাঘ্রবাহিনী দেবীও দেখতে পাওয়া যায়। বিশেষ করে উত্তর ও
পশ্চিম ভারতে ব্যাঘ্র-এর ওপর অষ্টভুজা
দুর্গার বিগ্রহই বেশি নির্মিত হয়।
‘শেরওয়ালি’ মা
নামেই তিনি সাধারনের কাছে পরিচিত।
উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ির বিখ্যাত বংশের দেবীও হলেন ব্যাঘ্রবাহনা। কোচবিহার
রাজবংশের দেবীর পায়ের কাছে সিংহের সাথে
বাঘও অবস্থান করেন। আবার কলকাতার চিত্তেশ্বরী
দুর্গা মন্দিরেও দেবীর সঙ্গে বাঘের উপস্থিত দেখতে পাওয়া যায়। ঠিক তেমনই, পশ্চিম
বর্ধমানের নবগ্রামেও বহুবছর ধরে হয়ে চলে
আসছে ব্যাঘ্রবাহিনী দেবীর আরাধনা।
প্রসঙ্গত, অজয় নদের পাশেই
নবগ্রাম, মূলত এটি কয়লাখনি
অঞ্চল, শোনা যায় যে,
বিরাট রাজাদের রাজ্য ছিল এই নবগ্রাম।
অজ্ঞাতবাসে থাকার সময় পাণ্ডবরাও এসেছিলেন
এই গ্রামে। বর্তমানে এখানে দুটি পারিবারিক পুজো
হয়। একটি চক্রবর্তীদের এবং
অন্যটি চট্টোপাধ্যায়। তবে মুখোপাধ্যায় ও
ভিন্ন গোত্রীয় চক্রবর্তীদের। দুটি পুজোর মূর্তির
গঠন সম্পূর্ণ আলাদা। চক্রবর্তীদের মূর্তি সিংহবাহনা এবং তিনশরিকের মূর্তিতে
মা স্বয়ং বাঘের পিঠে দণ্ডায়মানা।
প্রসঙ্গত, মনে করা হয়,
এই দুই পরিবারের বিবাদের
জেরেই পাল্টে যায় মূর্তির গঠন।
চক্রবর্তীদের দুর্গার বামপাশে থাকে লক্ষ্মী, ডান
পাশে সরস্বতী। আর তিনশরিকের পুজোয়
বামে সরস্বতী, ডানে লক্ষ্মী। ব্যাঘ্রবাহনা
দেবীর গায়ের রঙ তপ্তকাঞ্চনবর্ণা। শোনা
যায় যে, ৩৫০ বছর
আগে চক্রবর্তীরাই এই দুর্গাপুজোর প্রচলন
করেন। তখন শুধুমাত্র অসুরদলনী
দুর্গামূর্তিই থাকত। লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গনেশ পরবর্তীকালে যুক্ত
হয়।
রথযাত্রায় দিন দেবীর কাঠামোয়
মাটি পড়ে। বংশপরম্পরায় কুমোর ও ঢাকি আসেন
এ বাড়ির পুজোয়। পরিবারের সমস্ত সদস্যরা একসাথে উপভোগ করেন শারদোৎসবের আনন্দ।
উল্লেখ্য, ব্যাঘ্রবাহনা দেবীর পুজো হয় পি.এম.বাগচী পঞ্জিকা
অনুযায়ী। সপ্তমীতে চালকুমড়ো, সন্ধিপুজোয় শ্বেতছাগ এবং মহানবমীতে
কৃষ্ণছাগ বলিদান হয়। গৃহদেবতা রঘুনাথ
জীউকে ভোগদানের পরই দেবীকে ভোগ
দেওয়া হয়। পঞ্চব্যঞ্জনে ভোগ
দেওয়া হয়। ভোগে কচু,
কুমড়োর তরকারি আবশ্যক। সেই সঙ্গে থাকে
পায়েস ও মিষ্টি। দশমীর
সকালে অপরাজিতা পুজোর পর ঘট ও
নবপত্রিকা বিসর্জন হয়। দেবীকে দই,
চিড়ে খাইয়ে বিদায় জানানো হয়, এটাই পরিবারের
প্রাচীন রীতি। এরপরই সধবারা সিঁদুর খেলেন। নবপত্রিকা বিসর্জনের সময় বাড়ির সধবা
মহিলারা দেবীকে বরণ করেন, হাতে
দেন গুড়পুঁটুলি আর কড়ি। এই
গুঁড়পুটুলি আসলে শালপাতায় মোড়া
একটি করে গুড়ের নাড়ু।কড়ি
হল পথখরচা।
বলাবাহুল্য, পরিবারের সদস্যরা মনে করেন যে, মায়ের শ্বশুরগৃহে ফিরে যাওয়ার সময় সঙ্গে কিছু মিষ্টি দেওয়া বাঞ্ছনীয়। এই বাড়িতে মহাষ্টমীর দিন ঢাক বাজে না। সকলের ঘরের গৃহলক্ষ্মীরা একদিন পুজোমণ্ডপে একসাথে পুজো পান এবং দশমীর দিন রাতে শোভাযাত্রা সহকারে দেবীকে বিসর্জন দেওয়া হয়।
Article by: শুভদীপ রায় চৌধুরী