কলাবউকে থান কাপড় পরানো হয় খড়দহের গোস্বামী বাড়িতে
কলকাতা:
পিতৃপক্ষের অবসানে দেবীপক্ষ শুরু হয়ে গিয়েছে,
আজ দ্বিতীয়া। বনেদি বাড়ির পুজোর পাশাপাশি বারোয়ারি পুজো মণ্ডপ উদ্বোধন
হতে শুরু করেছে। মণ্ডপে
মণ্ডপে ভিড় জমাচ্ছেন সাধারণ
দর্শনার্থীরা। মহালয়ার দিন থেকেই শ্রীভূমি
স্পোর্টিং ক্লাবের ভিড় দেখে মনে
হচ্ছে সেদিনই মহাষ্টমীর রাত। কাতারে কাতারে
মানুষ আসছেন পুজো মণ্ডপে তাদের
উমাকে একবার দর্শন করতে। ঠিক তেমনই বনেদি
বাড়ির ঠাকুরদালানে চলছে চূড়ান্ত প্রস্তুতি।
খড়দহের গোস্বামী বাড়ির দুর্গাপুজো বহু প্রাচীন, শুরু
করেছিলেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের অন্যতম প্রধান পার্ষদ প্রভু নিত্যানন্দ। সেই থেকে বছরের
পর বছর ধরে একই
ধারাবাহিকতা বজায় রেখে পুজো
করে আসছেন নিত্যানন্দের বর্তমান বংশধরেরা।
সময়টা ১৪৫২ শকাব্দের আগে।
প্রভু নিত্যানন্দ খড়দহে এসে পুরন্দরের দেওয়া
২৬ বিঘা জমিতে বসবাস
শুরু করেন, আজকে যেটি “কুঞ্জবাটি” নামে
পরিচিত। বলাবাহুল্য, তিনিই মানব সমাজকে প্রেমভক্তি
রসে সর্বপ্রথম উজ্জীবিত করেছিলেন। আনুমানিক ১৪৫২ শকাব্দে অর্থাৎ
১৫৩০ সালে প্রভু নিত্যানন্দ,
শ্রীপাট খড়দহে নিজের বাসভবনে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন। সেই হিসাবে চলতি
বছর ৪৯৪ বছরে পদার্পন
করল গোস্বামী বাড়ির দুর্গাপুজো।
প্রসঙ্গত, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিত্যানন্দ
প্রভুর পরিবারও প্রসারিত হতে থাকে এবং
বিভিন্ন পরিবারে বিভক্ত হয়। যেমন- কিশোর
পরিবার, বিহারি পরিবার, মাধব পরিবার, লাল
পরিবার। এই সমস্ত পরিবারের
হাত ধরে প্রাচীন দুর্গাপুজোর
ধারা এখনও অব্যহত। নিত্যানন্দের
পুত্র বীরভদ্র তৎকালীন গৌড়ের নবাব সুলেমান খাঁর
কাছ থেকে একটি কষ্টিপাথর
নিয়ে এসেছিলেন এবং সেই কপাথর
দিয়েই তিনি শ্যামসুন্দরের মূর্তি
তৈরি করান। মূর্তি তৈরি করেন নয়ন
ভাস্কর। সেই মূর্তিই আজ
তাঁদের পরিবারের গৃহদেবতা। সেই ইতিহাসও বহু
প্রাচীন।
তাছাড়া, নিত্যানন্দের প্রতিষ্ঠিত কাত্যায়নী দুর্গাপজোর বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য
রয়েছে। সাবেকি এক চালার প্রতিমায়
শোলার কারুকার্য খচিত অলংকারে শোভিত
দুর্গার ষষ্ঠরূপ কাত্যায়নী। এই রূপে দুর্গার
দুইপাশে দেবী লক্ষ্মী ও
সরস্বতীর জায়গায় বিরাজমান দুই সখী জয়া
ও বিজয়া। প্রভু নিত্যানন্দ বিশ্বাস করতেন কাত্যায়নীর পুজো করলেই গৌরকে
পাওয়া সম্ভব। তাই গৌরের সঙ্গে
সাদৃশ্য রাখতে এখানে দুর্গার পাশে তার দুই
সখীকে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। তবে কার্তিক
ও গনেশ অপরিবর্তিত।
দেবীর বাহন সিংহ এখানে
ঘোটকাকৃতি।
এ বিষয়ে কথা
হল নিত্যানন্দ প্রভুর ত্রয়োদশ বংশধর স্বরজেন্দ্রমোহন গোস্বামীর সঙ্গে। তিনি জানান, প্রভু
নিত্যানন্দের সপ্তমপুরুষ মদনমোহনের মেজো ছেলে ভুবনমোহনের
বংশধররা হলেন মেজ বাড়ির
সদস্য। এই মেজ বাড়ির
গৃহদেবতা গোপীনাথ। বাড়ির উল্টোদিকেই সেই গোপীনাথ মন্দির।
উল্টোরথের দিন গোপীনাথ মন্দিরে
দেবীর কাঠামোপুজো হয়। মেজো বাড়ির
পুজোর রীতি অনুযায়ী বাড়ির
চণ্ডীকে কৃষ্ণানবমী তিথিতে কুলদেবতা শ্যামসুন্দরের মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই দিন
থেকে শুরু হয় দুর্গাপুজো।
কৃষ্ণানবমী থেকে শুক্লা নবমী
পর্যন্ত এই ১৫দিন চলে
গোস্বামী বাড়ির শারদোৎসব। প্রতিপদের দিন শ্যামসুন্দরের মন্দির
থেকে চণ্ডীকে নিয়ে আসা হয়। ষষ্ঠীর
দিন সন্ধ্যায় বোধন হওয়ার পর
দেবীকে সিংহাসনে তোলা হয়।
উল্লেখ্য, সপ্তমীর দিন সকালে বাড়ির
সদস্যরা সকলে মিলে কলাবউকে
গঙ্গায় শ্যামের ঘাটে নিয়ে যান।
ফিরে এসে নিত্যানন্দ প্রভুর
রীতি মেনেই কলাবউকে থান কাপর পড়ানো
হয়। কথিত আছে যে,
প্রভু নিত্যানন্দ যখন পুজোর আয়োজন
করেন, তখন এক মহিলা
তাঁকে একটি থান কাপড়
দিয়ে যান। প্রভু তখন
সেই কাপড়টি কলাবউকে পরিয়ে দেন এবং সধবার
চিহ্ন স্বরূপ তিনি সেই থান
কাপড়ের ওপর সিঁদূরের রেখা
টেনে দেন। সেই প্রথা
মেনে আজও কলবউ এর
সাজ করে আসছেন বংশের
বর্তমান প্রজন্মের সদস্যরা।
এই পরিবারে সম্পূর্ণ
বৈষ্ণব আচারে পুজো হয়। এই
পুজোয় কোন বলিদান করা
হয় না। অশুভ শক্তিকে
দূরে সরিয়ে মায়ের কাছে যাতে কোন
বিঘ্ন না আসে তারজন্য
মন্ত্রের সাহায্যে মাসকলাই বলি দেওয়ার রীতি
আছে। এই সময় পরিবারের
সবাই একত্রিত হয়, মায়ের আরাধনা
করেন। পুজোর সময় মায়ের প্রসাদ
সকলের জন্য বরাদ্দ থাকে।
এছাড়া বাড়ির সকলের জন্য সাদাভাত, শুক্তো,
মুগ ঘন্ট, খিচুড়ি, বেগুনি, ডাল, পোস্ত, চচ্চড়ি,
পোলাও, ধোকা, ছানা কালিয়া, চাটনি,
পরমান্ন, মিষ্ঠান্ন, লাউঘন্ট ইত্যাদি তৈরি হয়।
বিজয়া দশমীর দিন পরিবারের সকলে
সিঁদুর খেলার পর সকলে মিলে
প্রতিমা নিরঞ্জনের শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। আগে দেবীকে জোড়া
নৌকায় তুলে গঙ্গাবক্ষে ঘুরিয়ে
তারপর বিসর্জন করা হত, তবে
বর্তমানে তা বন্ধ রয়েছে।
বিসর্জনের পর পরিবারের সকলে
শ্যামসুন্দরের মন্দিরে আসেন। সেখানের পুরোহিতরা সকলের মাথায় রাধেশ্যামের পরিহিত কৌপিনের টুকরো বেঁধে দেন। এই প্রথাকেই
প্রভু নিত্যানন্দ মিলনের প্রতীক হিসাবেই দেখিয়ে গিয়েছিলেন।
Article by: শুভদীপ রায় চৌধুরী