মহাষ্টমী এবং মহানবমীর দিন ‘মাস ভক্ত বলি' র বিশেষ আয়োজন করা হয় সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারে
কলকাতা:
কলিকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানুটি তিনটি
বর্ধিষ্ণু গ্রাম। ১৬৯৮ সালে জোব
চার্নকের জামাতা চার্লস আয়ার সাবর্ণ চৌধুরীদের
থেকে গ্রাম তিনটির প্রজাসত্ত্ব পান বার্ষিক ১৩০০
টাকা খাজনার বিনিময়ে। তার বহু আগেই
উন্নত জনপদ বড়িশা গ্রামে
কলকাতার প্রথম দুর্গাপুজো শুরু করেন রায়
চৌধুরী বংশের সুসন্তান লক্ষ্মীকান্ত রায় চৌধুরী এবং
তাঁর স্ত্রী ভগবতীদেবী। তিলোত্তমার আদি জমিদার রায়
লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার চৌধুরী ১৬০৮ সালে মানসিংহের
থেকে আটখানি পরগণার নিষ্কর জমিদারি পাওয়ার পর ১৬১০ সালে
বড়িশায় আটচালার চণ্ডীমণ্ডপ নির্মাণ করে সপরিবার দুর্গার
পুজো শুরু করেন। কাঠের
থামের উপর হোগলাপাতার ছাউনি
দেওয়া আটচালা মণ্ডপেই দেবী আরাধনা শুরু
হয়। পরে এর সঙ্গে
যুক্ত হয় ষোলোটি থামবিশিষ্ট
একটি বিরাট নাটমন্দির। বর্তমানে তার বহু অংশই
সংস্কার করা হয়েছে।
সাবর্ণ চৌধুরীদের আদি পদবী গঙ্গোপাধ্যায়,
১৬০৮ সালে জমিদারির সঙ্গে
রায়, চৌধুরী এবং মজুমদার এই
তিনটি উপাধিও লাভ করেন তাঁরা।
লক্ষ্মীকান্ত দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন প্রজাদের
আনন্দবর্ধনের জন্য, সে কারণে পুজোর
কটাদিন চৌধুরী বাড়িতে ছিল সকলের অবারিত
যাতায়াত। এই বংশের দুর্গাপুজো
শুরু হয় কৃষ্ণানবমীর বোধন
দিয়ে। বর্তমানে রায় চৌধুরী বংশে
আটটি দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। বড়িশায় ছয়টি
(আটচালা, বড় বাড়ি, মেজবাড়ি,
মাঝের বাড়ি, বেনাকী বাড়ি ও কালীকিঙ্কর
বাড়ি) এবং একটি বিরাটি
রায় চৌধুরী বাড়ি ও নিমতা
পাঠানপুর বাড়ি। জন্মাষ্টমীর দিন কাঠামোপুজো অনুষ্ঠিত
হওয়ার পর ঠাকুরদালানেই প্রতিমা
নির্মাণ শুরু হয়। রায়
চৌধুরীদের দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয় মিথিলা কবি
বিদ্যাপতি রচিত দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী পুঁথিতে।
একচালার সাবেকি প্রতিমায় থাকে টানাচৌরি আকৃতির
ত্রিচালা। চালচিত্রে দশমহাবিদ্যা ও রাধা-কৃষ্ণের
পটচিত্র অঙ্কিত থাকে। সাবেকি গহনায় সেজে ওঠেন চৌধুরীদের
জগত্তারিণী শ্রীদুর্গা। শ্রীদুর্গার একপাশে থাকেন শ্রীরামচন্দ্র এবং অন্য পাশে
মহাদেব, তাঁদের নিত্য পূজা হয়। দেবীর
গায়ের রঙ শিউলি ফুলের
বোঁটার মতন, অসুর সবুজ
এবং গণেশ লাল বর্ণের
হয়। বড় বাড়ি, মেজবাড়ি
ও নিমতা বাড়ির সিংহ ঘোটকাকৃতি। অতীতে
কৃষ্ণবর্ণের কার্তিক আদিবাসী সম্প্রদায়ে পূজিত হতেন। লক্ষ্মীকান্ত সর্বপ্রথম দেবরাজ রূপে কার্তিককে স্থান
দেন সপরিবার প্রতিমায়। তাই চৌধুরীদের ঠাকুরদালানে
কার্তিকের বিশেষ সাজ দেওয়া হয়।
সাবর্ণ পরিবারে নবপত্রিকা স্নান সপ্ততীর্থের জল দিয়ে আটচালাতেই করানো হয়। মহাষ্টমী এবং মহানবমীর দিন এই বাড়িতে একটি বিশেষ পুজো সম্পন্ন হয়, যেটি হল 'মাস ভক্ত বলি'। অর্থাৎ ১৮০টা খুড়িতে মাসকলাই এবং দই দিয়ে এই অপদেবতা আর উপদেবতাদের সন্তুষ্ট করা হয় যাতে তারা পূজায় কোনও বিঘ্ন ঘটাতে না পারে। সেকালে সাবর্ণ চৌধুরীদের দুর্গাপুজোয় নয়টি পাঁঠা এবং দুটি মোষবলি হলেও বর্তমানে সে প্রথা বন্ধ রয়েছে। তবে বড়বাড়িতে প্রতীকী ফল বলিদান সম্পন্ন হয়। সপ্তমী ও মহাষ্টমীর সন্ধিক্ষণে অর্ধরাত্রবিহিত বিশেষ পূজার আয়োজন করা হয় বড়বাড়িতে। সন্ধিপূজায় ১০৮ পদ্ম ও প্রদীপের পাশাপাশি ল্যাঠামাছ পোড়া দেওয়া হয় এই বংশে। মহানবমীর দিন কুমারি পুজো অনুষ্ঠিত হয় বড় বাড়ি ও বিরাটি বাড়িতে। মহাপূজার প্রতিদিনই আমিষ ভোগ (নিমতা বাড়ি ছাড়া) নিবেদন করা হয় দেবীকে। ভোগে থাকে- পোলাও, খিচুড়ি, নানান ভাজা, তরকারি, মাছ, চাটনি, পায়েস ও মিষ্টি। দশমীর দিন অপরাজিতা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। ছেলেরা ডানহাতে এবং মেয়েরা বামহাতে অপরাজিতার লতা বাঁধেন। দর্পনের বিসর্জনের পর বিকালে প্রতিমা বিসর্জন সম্পন্ন হয়। এ বাড়িতে কনকাঞ্জলি প্রথা রয়েছে এবং বাড়ির মহিলারা সিঁদুর খেলার পর দেবী একবছরের জন্য শ্বশুরবাড়িতে রওনা দেন। অতীতে কাঁধে করে প্রতিমা বিসর্জন হলেও বর্তমানে ট্রাকেই শ্বশুরবাড়ি যান সাবর্ণদের উমা।
Article by: শুভদীপ রায় চৌধুরী