Jaatishwar-জাতিস্মর (Bengali Story)

উফ্‌ কি গরম বাপি। আর কতক্ষন এখানে থাকতে হবে? আমার আর ভালো লাগছে না এসব শুনতে। সবই তো সেই একই জিনিষ, খালি রাজার সাথে রাজার যুদ্ধ, মারামারি, রক্ত, ধুস। মাথার টুপিটা হাতে খুলে নিয়ে রেগে গট গট করে মিউসিয়ামের বাইরে চলে গেলো বারো বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে। সেদিকে তাকিয়ে আবার মিউসিয়ামের ভিতরে রাখা একটা নকশায় মন দিলেন রাজীব বাবু। আমেরিকা থেকে সপ্তাহ দুয়েক আগে নিজের জন্মভুমিতে এসেছেন উনি। ছোট থেকেই রাজীব বাবুর এই জায়গাটা খুব টানে, বালি আর দুর্গে ঘেরা এই রাজস্থানের ছবি বা ভিডিও দেখলেই যেন মনে হয় আগের কোন জন্মে এখানে এসেছিলেন, সব কিছুই যেন খুবই চেনা। উনি এদেশে এসেছেন অনেকবার কিন্তু রাজস্থানে কয়েকদিন আগেই এলেন। আজ এই চিতোর দুর্গের নীচের মিউসিয়ামে এসেছেন কিন্তু ওখানে সাজানো সব জিনিষই ওনার খুব চেনা লাগছে, ওই দিকের দেওয়ালে ঝোলানো একটা বিশাল বাঁকানো তলোয়ার, হাতলের দিকটায় কত রকমের রত্ন লাগানো, বড্ড চেনা লাগছে ওনার, কে জানে কোথায় দেখেছেন, হয়ত টিভিতে দেখেছন আর এখন তাই চেনা লাগছে, হতেও তো পারে এমন, কিন্তু ওই তলোয়ারের নীচের ধারালো নখের মতো অস্ত্রটাও তো চেনা। ওটার নাম “বাঘনখ”। পাশের দিকে আবার লম্বা মতো ওটা, ওটা তো ভীলদের বাঁশের সেই বিখ্যাত বর্শা। ওই তো, ওই জোড়া তলোয়ারটাও তো বড্ড চেনা, এটার আওয়াজ যেনো এখনো কানে ঝন ঝন করে বাজছে। পাশে আবার একটা ধারালো গুপ্ত ছুঁড়ি, নীচে লেখা রানা প্রতাপের নাম। জানিনা বাবা কি যে হচ্ছে, তার থেকে বরং যুদ্ধের যে নকশাটা দেখা যাচ্ছে সেটাই দেখায় মন দিলেন রাজীব বাবু, এটাও যে আরও বেশি চেনা লাগছে সেটা ওনার চোখ মুখের ভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে।


এই যে দাদা এদিকে দেখুন, আমি কিন্তু আর হলদিঘাটির যুদ্ধের বর্ণনা রিপিট করতে পারব না, বেশ বিরক্ত মুখে এই মিউসিয়ামের গার্ড সবার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ১৫৭৬ সালের ১৮ই জুন হলদিঘাটির এই জায়গায় রাজা রানা প্রতাপের সাথে আকবরের সেনাপতি প্রথম মানসিংহ এর যুদ্ধ হয়। রাজার সাথে ছিল মাত্র পনেরোশো পদাতিক সৈন্য, রাজা প্রতাপ নিজে ঘোড়ায় চড়ে অন্যদিকে মোঘলরা প্রায় দশ হাজার পদাতিক আর অসংখ্য হাতি নিয়ে অন্য দিকে সাড় বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। হটাৎই রাজীব বাবুর মাথাটা কেমন যেন টলে উঠলো, গা গুলিয়ে উঠলো ভেতর থেকেই, মনে হল কেউ অসংখ্য হাতুড়ি পেটাচ্ছে ওনার মাথার ভিতরে, শরীরের ভারসাম্য রাখতে না পেরে পরে উনি পড়ে গেলেন মেঝেতে। বুঝতে পারলেন আসেপাশের লোক ওনার কাছে দৌড়ে এসেছে, সবার ঠোঁট নড়ছে কিন্তু ওরা কি বলছে তা বুঝতে পারছেন না উনি। হটাৎই চোখের সামনে ঘষা কাঁচের মতো একটা দৃশ্য ভেসে উঠলো। চারদিকে অসংখ্য কালো কালো মাথা, সবাই যুদ্ধের পোশাকে সজ্জিত, উনিও সেই রনসাজে এই বিরাট যুদ্ধক্ষেত্রের একপাশে পদাতিক সৈন্যের সাথে দাঁড়িয়ে আছেন, চারদিকের প্রচণ্ড চিৎকারে কান পাতা দায়। এবার উল্টোদিকের ম্লেচ্ছ মোগলরা দৌড়াতে শুরু করলো, এবার রাজীব বাবু “জয় ভবানী” বলে ছুটলেন ওদের উদ্দেশে। শুরু হল যুদ্ধ। চারিদিকে চিৎকার আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে, দু তরফ থেকেই তীরের বৃষ্টি হচ্ছে।  তার মধ্যেই তীরের ফলার মতো হাওয়া কেটে ছুটে চলেছেন উল্টোদিকের মোগল সৈন্যদের পাশ দিয়ে আর কলা গাছের মতো ঢিপ করে পড়ে যাচ্ছে এক একজন, রক্তে হলদিঘাটির মাটি লাল হয়ে উঠেছে,  এবার সামনে দেখতে পেলেন দুটো বড় হাতি রন সাজে যুদ্ধ করছে, ওনার দলের প্রচুর যোদ্ধা নিহত এর মধ্যেই কিন্তু রাজীব বাবুকে আজ আটকাতে পারবে না ওই মোগলরা। ধুলোর ঝড় তুলে প্রায় চোখের নিমেষে ওদের মাঝ থেকে বেরিয়ে গেলেন উনি, এবার ওনার লক্ষ্য সামনের বিশাল হাতিটা যার ওপরে বসে আছে মোঘলের কুচক্রী সেনাপতি মানসিংহ। আজ যেন উনি অজেয়, গায়ে কেটেছে সামান্যই কিন্তু তার পরোয়া করেন না, জন্মভূমির কিছুটা ঋণ শোধ করার সময় এসেছে আজ। এবার পিঠে হালকা চাপ অনুভব করলেন, বুঝে গেলেন কি করতে হবে এবার ওনাকে, আর মাত্র হাত পাঁচেক দূরে মানসিং এর রনহাতি, পাগলের মতো মাথা দোলাচ্ছে চারদিকে যাতে কেউ  তার ধারে কাছে যেতে না পারে, এবার সেই হাতি লক্ষ্য করে দিলেন এক লাফ, মুহূর্তে ঘটে গেলো একসাথে কয়েকটা ঘটনা, ওনার পিঠ থেকেও লাফ দিলো ওনার প্রভু রানা প্রতাপ, সাথে সাথে উনি লক্ষ করলেন শণ শণ শব্দে হাওয়া কেটে বিদ্যুতের থেকেও তীব্র গতিতে মানসিং এর দিকে ধেয়ে গেলো রানার হাতের মুঠো থেকে বেরনো ভীলের চকচকে ফলার বর্শা, কিন্তু বিধি বাম, লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সেটা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিলো মাহুত সমেত হাতিটার মাথা কিন্তু তার মধ্যেই রাজীব বাবু টের পেলেন সেই রন নিপুন হাতির শুঁড়ের তলোয়ার চিঁড়ে দিয়েছে ওনার পেট। মাটিতে পড়ার সাথে সাথে প্রচন্ড ব্যথা শুরু হলো তল পেটের নিচে। হলুদ বালি কাঁকড় মেশানো মাটি লাল হয়ে গেলো গরম রক্তের ধারায়। বুঝতে পারলেন প্রভুকে নিয়ে এই যুদ্ধ করা সম্ভব নয় আর। হাওয়ার উল্টোদিকে ছুট লাগালেন এবার প্রভুকে নিয়ে, বুকে প্রচণ্ড ব্যাথা আর রক্তপাত গ্রাহ্য না করেই ছুটে চলেছেন উনি। মুহূর্তে ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় স্বয়ং রানাও বোধহয় হতচকিত হয়ে গেছিল।  সামনে একটা নদী, কিন্তু রানার প্রাণ বাঁচাতে এই নদী আজ পেরোতেই হবে। আর মাত্র কয়েক হাত দূরেই এই নদীর ঢাল, কিছু না ভেবেই চোখ বন্ধ করে দিলেন ওনার জীবনের শেষ লাফ নিজের প্রভুকে নিয়ে। প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে শেষ বারের মতো যখন চোখ খুললেন, ব্যাথায় ওনার চোখ থেকে অঝোরে জল পড়ছে,  এই জল যত না দুঃখের তার থেকেও বেশি গর্বের। নিজের প্রাণ থাকতে ক্ষতি হতে দেননি উনি ওনার প্রভুর। ওনার মাথা তখন রানার কোলে, মনে মনে বললেন ক্ষমা করো প্রভু, এই যুদ্ধে তোমায় জয় এনে দিতে পারলো না তোমার এই আদরের চৈতক। ভালো থেকো তুমি বন্ধু। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল চৈতক। রানার চোখ ভিজে গেলো, গালের ধার বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো চৈতকের কপালে। মুখে বললেন, চৈতকের মৃত্যু হয় না। যেখানেই থেকো ভালো থেকো বন্ধু।


হাতের স্পর্শে চৈতন্য হল রাজীব বাবুর, সামনে তাকিয়ে দেখলেন সেই বাচ্চা মেয়েটা ওনার মাথা নিজের কোলে তুলে রেখেছে, অস্পষ্ট আদুরে গলায় কয়েকটা শব্দও ওনার কানে ভেসে এলো। কিন্তু রাজীব বাবু একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন সেই মুখের দিকে, এই মুখ যে এখন ওনার বড্ড চেনা।

সমাপ্ত।

#কলমেঃ কালো ঘোড়া

Post a Comment

Previous Post Next Post