প্রামাণিক কালী বাড়ি - Pramanik Kali Bari

 ৩৭/ তারক প্রামাণিক রোড, শিমুলিয়া কাঁসারি পাড়া, সিমলা,কলকাতা (গিরিশ পার্কের সন্নিকটে, বিধান সরণি থেকে তারক প্রামাণিক রোড ধরে সেন্ট্রাল এভিনিউ এর দিকে এগোতে ডান হাতে পড়ে),

সাতঘর প্রামাণিক নামের এই বংশের বাস ৪০০ বছরের বেশী সময়ের। আনুমানিক ১৬৬৮ খ্ৰীস্টাব্দ থেকে এই বংশে কালী জগদ্ধাত্রী আরাধনা শুরু হয়। স্বর্গীয় প্রসাদদাস প্রামাণিকের বংশ লতিকা শেষবার ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৯৩০ সালে, শেষ পুনর্নবিকরণ করা হয়েছিল।


সিমলা অঞ্চলের প্রামাণিক বাড়ী। গিরীশ পার্ক এর সন্নিকটে শিমুলিয়া কাঁসারি পাড়ায় তারক প্রামাণিক রোডে শতবর্ষ পার হওয়া এই বাড়ী আজও সমহিমায় দাঁড়িয়ে। ঈশ্বর বক্রেশ্বর প্রামাণিকের বংশধর স্বর্গীয় অমৃতলাল প্রামাণিক স্বর্গীয় নৃত্যলাল প্রামাণিক এই ত্রিতল বাড়ী নির্মাণ করেন আনুমানিক ১১০ বছর আগে অর্থাৎ প্রায় ১৯০৮ সালে। এই বাড়িটির প্রধান দুটি ভাগ। একটি থাকবার জন্য আরেকটি ঠাকুর বাড়ী। স্বর্গীয় নৃত্যলাল প্রামাণিক তাঁর পাঁচ পুত্রের পরিবার এক দিকে থাকতেন। আজ তারই পাশে তাঁরা আরও তিনটি বাড়ী করে ওখানেই থাকেন। ঠাকুর বাড়ীতে স্বর্গীয় অমৃতলাল প্রামাণিকের একমাত্র পুত্র স্বর্গীয় কালিসাধণ প্রামাণিক তাঁর পরিবার থাকতেন। এই বাড়ীর সদর দরজা বরাবর দুই ধারে লাল রোয়াক তারপর উঠোন পেরিয়ে শ্বেতপাথরে বাঁধানো দালান। এই দালানে নিত্যপুজো হয় কাঠের চৌকির উপর।প্রতি বছর এখানেই শ্রী শ্রী দক্ষিণা কালী শ্রী শ্রী জগদ্ধাত্রী পুজো করা হয় খুব ঘটা করে, যার আনুমানিক হিসেব ৩৫০ বছরের উপর।


বছর দশেক আগেও এখানে পাঁঠা বলির চল ছিল, যা সর্বসম্মতিক্রমে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আজও উঠোনের মাঝে ঢাকনা দেওয়া জায়গা আছে যা খুললে মাটি বেড়োবে, যেখানে হাড়িকাঠ পোঁতা হত।এই বাড়ীর বৈশিষ্ট্য বাড়ীর সিঁড়ি, যার বেশির ভাগটাই খোলা। খিলান দেওয়া দালানের উপরেই টানা বারান্দা যাকে লক্ষ্মী বারান্দা বলা হয় কারণ গৃহলক্ষ্মীর ঘর ওখানেই। পুজো পার্বণে লক্ষ্মী নামানোটাও দেখার মত। বাড়ীর কোনও বধূ তাঁকে মাথায় করে নিয়ে ধীর পায়ে দালান অবধি আসেন। বারান্দার পিছনটায় দালানের ছাদ, এবং এটি এমন ভাবে বানানো যাতে সরাসরি ওর ওপর দিয়ে কেউ হেঁটে না যায়। বাইরের দিকে প্রতি তলায় বড় ঘর বারান্দা। আলোর ফানুশ, ঝাড়বাতির রোশনাই আজ সময়ের সাথে মলীণ হলেও তা ঝকমক করে ওঠে কোনও বিশেষ দিনে, ঠিক যেমনটি করে দীপাবলির দিনে।


বাড়ীর কালী দক্ষিণা কালিকা রূপ কন্যা রূপেই পূজিতা হন। একই গড়নের মূর্তি তৈরি হয়ে আসছে সেই শুরু থেকে। বহুদিন আগে সম্পূর্ণ মূর্তি বাড়িতেই বানানো হত। বর্তমানে মাটির কাঠামোটি বানিয়ে আনার পর তার রঙ সাজ বাড়িতে করা হয়। বংশ পরম্পরায়ে চলে আসা পূজোয় দেবীর গয়না বহু পুরাতন, তবে এখনও অনেকেই কিছু সংযোজন করে থাকেন। পূজোর আগের দিন এই গয়না পরানো হয়। বাড়ীর প্রায় সকলেই এতে অংশ নেন। মায়ের চার হাতে ওপর হাতে থাকে সোনার অলঙ্কার। পায়ে মল, পায়েল রুপোর। ছাড়া বহুবিধ হার, সীতাহারে সাজানো হয়, থাকে কানপাশা এবং নথ। কোমরে হাতের কোমরবন্ধ, মাথায় সোনা রুপোর মুকুট, হাতে সোনা রুপোর খাঁড়া। সোনার দাঁত -জীব, কপালে সোনার টিপ-অর্ধচন্দ্র, হাতে পিতলের মুণ্ড। মহাদেবের সাজ রুপোর, সঙ্গে দুই হাতে রুপোর শিঙা ডুগডুগি।


*এই সাজ নিয়ে এই পরিবারের কিছু পারিবারিক কাহিনী প্রচলিত আছে, এই সব কাহিনী জনশ্রুতি। একবার নাকি এক অতি বৃদ্ধা গয়না পড়ানোর ঠিক আগে এসে একটি নথ দিতে চান। প্রথা অনুযায়ী সবই লিখে রাখা হয় যে কে কি মা কে দিলেন। সেটা করবার সময় তিনি নাকি বলেছিলেন যেকালীঘাটের বড়দি বলেছেন আমি টে নথ পেয়েছি, দুটো তোরা রাখ, তাই দিদির জন্য নিয়ে এলাম, আমারটা নিয়ে ঠনঠনিয়া যাব যে কর্তা লিখছিলেন তিনি খাতা বের করতে ওঠায়, ফিরে এসে দেখেন বৃদ্ধা নেই, নথটি রাখা। তাঁর বিশ্বাস হয় যে স্বয়ং ঠনঠনিয়ার মা কালী এসে সেটি দিয়ে গেছিলেন। বিশ্বাসীরা মানবেন, তত্ববাদীরা বলবেন গল্প, তবে আজও বাড়ীর রোয়াকে বসে, এই পরিবারের বয়স্করা এই সব গল্পই করেন সকলে শোনে। আলোর রোশনাই, ঢাকের বাজনায় ওদিকে পূজোর তোড়জোড় শুরু হয়।


অমাবস্যা পড়ে গেলে ঠাকুরমশাই রুপোর সিংহাসন হাতে বামুনবাড়ী থেকে নারায়ণ আনতে যান যাতে অনেকেই সঙ্গ নেন তাঁর। নারায়ণ দালানে চলে এলে শুরু হয় লক্ষ্মী নামানোর প্রক্রিয়া। বাড়ীর বিবাহিতা কোনও বধূই এটা করে থাকেন যিনি 'স্ত্রী আচার' পালন করবেন শেষ অবধি। এই বিধির পরে শুরু হয় পূজো। চৌকির একধারে সাজানো থাকে নৈবেদ্য। অন্যদিক ভরে যায় ভক্তের নিবেদনে, ফলমিষ্টি , অবশ্যই ডাব চিনি। সঙ্কল্প করে শুরু হয় দক্ষিণা কালিকার আরাধনা। পূজো শুরুর পর বাড়ীর ছোটোরা পাশেই সিমলা ব্যায়াম সামিতীর মাঠে যায় বাজী ফাটাতে। অনেক ধরনের আতশবাজি ফানুশ ওড়ানো হয়ে থাকে, যা দেখবার মতো। বাড়ীতে বহু মানুষ দণ্ডি কেটে এসে তাদের মানত পূর্ণ করেন। পূজো শেষের সময়  হয় হোম, সঙ্গে চলে ধুনো পোড়ানো, যারা মায়ের কাছে মানত করেছেন, তাঁদের। সকলেই উপবাসের পরে অঞ্জলির অপেক্ষায় থাকেন, শুরু হয় অঞ্জলি, তারপর চরণামৃত নিয়ে উপবাস ভঙ্গ। পূজো শেষে মা বরাভয় হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন ভক্তের সামনে। সকালে দশমী পুজা প্রতিবিম্বে বিসর্জন। পরদিন সন্ধ্যায় বাড়ীর ছেলেরা মা কে দালান থেকে উঠোনে নামান গয়না খুলে সসম্পূর্ণ ফুলের সাজ পড়ানো হয় মুকুট থেকে পায়ের মল পর্যন্ত। এর পড়ে বরণ, যাতে বাড়ীর বধূরা বিবাহিতা কন্যারাই অংশগ্রহন করেন। মেয়ে জামাই কে বরণ করে হাতে পানের খিলি দেওয়া হয়, মুখে মিষ্টি। এর পর সকলে মিলে সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন। সকলে প্রণাম করে নেওয়ার পর হয় কনকাঞ্জলি। এর পর প্রস্তুতি মা কে সেই বছরের মতো বিদায় জানানোর। সকলে ধরে মা কে গাড়িতে তোলেন।


* বিসর্জন নিয়েও একটি পারিবারিক কাহিনী বহুলচর্চিত। এক বার এক কর্তা বিসর্জনের পড়ে বাড়ী ফেরেননি, তো সকলে ভেবেছে হয়তো বা কোনও বন্ধুর বাড়ী চলে গেছে। সদর বন্ধ হওয়ার পরে পুরো ভেজা অবস্থায় উনি ফিরে দরজা ধাক্কা দিতে তা কেউ খোলেনা, মা বলে ডাক দিতেই দরজার খিল কেউ ভিতর থেকে খুলে দেয় কিন্তু তাঁকে দেখা যায়না। তিনি নাকি পরে জানিয়েছিলেন যে, বিসর্জনের সময় সবার অগোচরে ওনার পা পিছলে যায় তিনি গঙ্গায় তলিয়ে গিয়েছিলেন, কেউ তাঁকে মাথার চুলের মুঠি ধরে পারে এনে ফেলেছিল, কিন্তু তাঁকে দেখা যায়নি। বিশ্বাস ভক্তি সব মিলেমিশে যায়।

Post a Comment

Previous Post Next Post